চিকিৎসকদের টানা দু’দিনের ধর্মঘটে খুলনায় চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়েছে।

 বিএমরাকিব হাসান খুলনা বুরো 

চিকিৎসকদের টানা দু’দিনের ধর্মঘটে খুলনায় চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়েছে।

, শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলার ঘটনার মামলায় সাতক্ষীরা সদর থানার সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) নাঈমুজ্জামান শেখকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। এছাড়া শ্লীলতাহানি ও স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ এনে বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ’র বিচারের দাবি জানিয়েছেন এএসআই নাঈমুজ্জামান শেখের স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না। অপরদিকে, ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলাকারী পুলিশের এএসআই নাঈমুজ্জামানকে গ্রেফতার ও তার স্ত্রীর দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না পর্যন্ত চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে চিকিৎসকরা। প্রয়োজনে গণপদত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন তারা।

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের বিশাল লাইন। রোগীদের কেউ এসেছেন, শহরের এ প্রান্ত থেকে, কেউ এসেছেন অপর প্রান্ত থেকে। আবার কেউ এসেছেন, দূরের কোনো জেলা থেকে। তারা সবাই এসেছেন চিকিৎসক দেখানোর জন্য। তবে, দীর্ঘ সময়েও চিকিৎসকের দেখা না পেয়ে তারা চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। 

নগরীর টুটপাড়া এলাকা থেকে আসা ফিরোজ আলম নামের একজন রোগী জানান, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার আগে এসে তিনি বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়েছিলেন। টিকিট পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও ডাক্তার না থাকায় তিনি ফিরে যাচ্ছেন।

মোংলার দ্বিগরাজ থেকে আসা মনিরা বেগম বলেন, বোনকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে ও টেস্ট করাবো বলে এসেছিলাম। কিন্তু এসে শুনি কর্মবিরতির কারণে ডাক্তাররা আজও রোগী দেখবে না। এতদূর থেকে এসে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের পরিচালক ডা. রবিউল হাসান জানান, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন দেড় হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসাসেবা নেন। তবে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি থাকার কারণে বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় গত দুদিন রোগীরা কোনো চিকিৎসাসেবা পায়নি।

তিনি বলেন, গত দুদিন হাসপাতালে ৩৭জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তবে, চিকিৎসকদের অবহেলায় কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ রকম মৃত্যু প্রতিদিনই হাসপাতালে হয় বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকলেও জরুরি বিভাগ খোলা রয়েছে। সেখানে রোগীদের স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে, শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ নিশাত আব্দুল্লাহ’র ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাতক্ষীরা সদর থানার সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) নাঈমুজ্জামান শেখকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। গত বুধবার রাত ৮টায় তাকে জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়।

সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজীব খান জানান, এএসআই নাঈমের বিষয়টি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।

এছাড়া চিকিৎসকদের আন্দোলনের মধ্যে শ্লীলতাহানি ও স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ এনে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ’র বিচারের দাবি জানান এএসআই নাঈমের স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না। বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে নুসরাত আরা ময়না বলেন, ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ আমার স্বামীর বিরুদ্ধে যে এজাহার দায়ের করেন তাতে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১০টায় আর ডা. বাহারুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমার স্বামী ঐ দিন রাত ১টায় সময় ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ’র ওপর হামলা করেছেন। কিন্তু আমার কাছে রাত ১১টা ৫৪ মিনিটের একটি ৪৪ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার নিশাত সম্পূর্ণ সুস্থ ও ভাঙচুরের কোনো আলামত নেই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কখন মারধর ও ভাঙচুর হলো?

তিনি প্রশ্ন করে বলেন, এই মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার স্বামীকে হয়রানি ও আমার মেয়েকে যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না তারফলে আমার মেয়ের হাতের যে  অবনতি হবে তার দায়ভার কে নেবে?

নুসরাত সংবাদ সম্মেলনে তার শ্লীলতাহানি ও স্বামীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার জন্য ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ’র বিচারের দাবি জানান।

প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনাসহ তার মেয়ের সুচিকিৎসার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বিএমএ কর্মকর্তারা শুধুমাত্র একপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতেই যে, কর্মবিরতি পালন করছে, সেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণের পরিপন্থী।’ সংবাদ সম্মেলনে তিনি সমাজের জাগ্রত বিবেক, নারী কল্যাণ সংস্থা, হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশন, মানবাধিকার কল্যাণ সংস্থাসহ সকলের প্রতি সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান। 

অপরদিকে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ’র ওপর হামলাকারী পুলিশের এএসআই নাঈমুজ্জামানকে গ্রেফতার ও তার স্ত্রীর দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে খুলনা বিএমএ। এছাড়া চিকিৎসকরা আগামীকাল শনিবার বেলা ১২টায় শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে বিক্ষোভ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। একইদিন সন্ধ্যা ৭টায় বিএমএ ভবন মিলনায়তনে জরুরি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রয়োজনে ঐ দিন চিকিৎসকরা গণপদত্যাগের করবেন। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় বিএমএ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন খুলনা বিএমএ’র সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম।

সংবাদ সম্মেলনে ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, ‘কর্মস্থলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধানে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যর্থ। রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসার স্বার্থেই কর্মস্থলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই সংকটময় মুহূর্তে রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। এ দায় সরকারের। এছাড়া এএসআই নাঈমুজ্জামানকে পুলিশ গ্রেফতার না করে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।’

ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ’র বিরুদ্ধে এএসআই নাঈমের স্ত্রীর আনা শ্লীলতাহানির সম্পর্কে ডা. বাহারুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কাউন্টার হিসাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এই মামলা সাজানো হয়েছে। যদি ঘটনা সত্য হতো তাহলে তিনি কেন আগে মামলা করেননি। আমাদের কাছে যখন ক্ষমা চাইতে এসেছেন, তখনও আমাদের বলেননি। অর্থাৎ কাউন্টার মামলা দেওয়ার জন্যই এই মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আসামি গ্রেফতার করে বিচারে সোপর্দ করলেই কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।’

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, চিকিৎসকদের সঙ্গে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে এটা কারো কাম্য নয়। একই সঙ্গে চিকিৎসকদের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন হওয়া উচিত। তারা মহান পেশার দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ রোগীদের কষ্ট দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়।

প্রসঙ্গত, ডা. নিশাত আবদুল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে গত বুধবার সকাল ৬টা থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন চিকিৎসকরা। এতে করে খুলনা মহানগরীসহ জেলার সকল সরকারি হাসপাতাল-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। 

 


Post a Comment

Previous Post Next Post