ডয়চে ভেলে
বলছেন, রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স সামান্য বেড়েছে।
কিন্তু আমদানি কমায় উৎপাদন কমছে। ফলে রপ্তানি কমতে বাধ্য। আর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম
বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক শিল্প উৎপাদন কমিয়ে দিতে বা বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে।
তবে আইএমএফ-এর ঋণ এলে ডলার সংকট কিছুটা কাটবে বলে মনে করেন তারা।রমজান মাসে ছয়টি আমদানি পণ্যের বিশেষ চাহিদা থকে৷ সেগুলো হলো ভোজ্যতেল,
চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজ। বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে
ফেব্রুয়ারি- এই দুই মাস এবং তারপর রোজার এক মাসের চাহিদা অনুযায়ী ওই ছয়টি পণ্য আমদানিতে
১৫৩ কোটি মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হয়। আর শুধু রোজার এক মাসের চাহিদা পূরণে এসব পণ্য
আমদানিতে প্রয়োজন ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার।
আগামী
মার্চের শেষ সপ্তাহে রোজা শুরু হচ্ছে। গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা শুরু হয়। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য
আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে আর এলসি খোলায়ও জটিলতা দেখা দিয়েছে।
অক্টোবর-ডিসেম্বরে এলসি খোলার হারও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত
বছরের শেষ চার মাসে অপরিশোধিত চিনির এলসি আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। এছাড়া অপরিশোধিত
সয়াবিন তেল ৪৭ শতাংশ, সয়াবিন ৮৩ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম তেল ৯৯ শতাংশ, ছোলা ৪৭ শতাংশ
ও খেজুর আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ।
আর যারা
এলসি খুলে পণ্য বন্দর পর্যন্ত এনেছেন তারা ডলার না থাকার কারণে বিল পরিশোধ করতে
পারছেন না, তাই পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না।
পরিস্থিতি
সামলাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বছরে যে ডলার ব্যয় হয়
তার ১০ থেকে ২০ শতাংশ রমজানের পণ্য আমদানির চাহিদা পূরণে আলাদাভাবে রাখার জন্য
বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে। এখন সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
হাতে।
চট্টগ্রাম
বন্দরে কয়েকজন আমদানিকারকের পণ্য আটকা পড়েছে বিল পরিশোধ না করতে পারার
কারণে। তাদের পণ্য খালাস করা হচ্ছে না। এতে তাদের বাড়তি জাহাজ ভাড়া গুণতে হচ্ছে।
আর বিল পরিশোধ পিছিয়ে দিলে জরিমানা গুণতে হবে।
এস আলম
গ্রুপ এবং মেঘনা গ্রুপের পণ্য এখন বন্দরের জাহাজে রয়েছে। পাম তেল, চিনি ও সয়াবিন
মিলিয়ে ৫৪ হাজার টন পণ্য বিল পরিশোধ না করতে পারায় তারা খালাস করতে পারছেন না।
তাদের মোট ৩.৫১ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ব্যাংকে ডলার মিলছে না। এই
পণ্যের বাজার-মূল্য ৬৪১ কোটি টাকা। তাদের এখন জরিমানা গুণতে হচ্ছে। প্রতিদিন জাহাজ
ভাড়া হিসেবে জরিমানা দিতে হচ্ছে মোট ৯৪ হাজার ডলার। এর আগে গত মাসে টিকে গ্রুপের
আমদানি করা পণ্য খালাসে ডলার সংকটের কারণে ১০ দিন দেরি হয়। এতে তাদের ১০ দিনের
বড়তি জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করতে হয় বলে জানান টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার।
মোস্তফা
হায়দার বলেন, ‘‘এখন তো আসলেই আমরা সমস্যায় পড়েছি। এখন আমাদের এলসি নিশ্চিত করাই
প্রধান চ্যালেঞ্চ। প্রথমে ডলার না থাকায় এলসি খোলা যাচ্ছে না। এলসি খুললেও পরে দাম
পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না বা পেতে অনেক দেরি হচ্ছে।”
তার কথা,
"এইসব কারণে আমাদের বাড়তি জাহাজ-ভাড়া গুণতে হচেছ। আবার আমাদের ওপর
সাপ্লায়ারদের আস্থা কমে যাচ্ছে। পরে হয়ত আদের জন্য পণ্য পাওয়াও কঠিন হয়ে যেতে
পারে। আর বিল পিছিয়ে দিলে জরিমানা দিতে হয়। এই সব ক্ষতিপূরণ নিয়ে আবার
সাপ্লায়ারদের সঙ্গে আমাদের ডিসপুট দেখা দিচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, পণ্যের খরচ বেড়ে
যাচ্ছে, তা আবার দামের ওপর প্রভাব ফেলবে।”
তিনি
জানান, তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলছেন,
চেষ্টা করছেন একটা সমাধানের।
তিনি
বলেন, "এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে এর প্রভাব বাজারেও পড়বে । সাধারণ বিবেচনায়
আমাদের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে যে দামে এখন আমরা বাজারে পণ্য দিচ্ছি, সেই
দামে হয়ত দিতে পারবো ন। আরেকটি বিষয় হলো, এখন ডলারের যে রেট সেই রেটে এক বছর পর
আমাদের টাকাটা দেয়া হবে। কিন্তু এক বছর পর ডলারের রেট কী হবে তা-ও আমরা ধারণা করতে
পারছি না। এখানেও আমাদের একটা ভয় আছে।”
সেন্টার
ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম
মোয়াজ্জেম মনে করেন, "ডলারের সংকট আমরা যা দেখছি বাস্তবে তার চেয়ে আরো
গভীরতর। প্রকৃত পক্ষে আমাদের ডলার কী পরিমাণ আছে, ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদার
বিপরীতে কী পরিমাণ পাচ্ছে তা নিয়মিত সপ্তাহভিত্তিতে তদারকি করা দরকার। কী পরিমাণ
এলসি আসছে, কোনগুলো আগে খোলা দরকার, কোনগুলো এখন খোলা দরকার নেই- বাংলাদেশ
ব্যাংকের সে ব্যাপারে নির্দেশনা প্রয়োজন। এখন আমাদের দরকার অর্থনীতিতে ভারসাম্য
রেখে প্রয়োজনের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, সেভাবে এলসি খুলতে দেয়া।”
তিনি
দাবি করেন, " সরকার বলছে, এখন রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার বলা হচ্ছে, কিন্তু
অন্যান্য হিসাব বলছে আমাদের রিজার্ভ আছে ২৪ থেকে ২৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে
আমাদের এক বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভের পতন হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৪
মাসের মধ্যে রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। এখন পর্যন্ত যা আশা, তা হলো, আইএমএফ-এর
ঋণ ছাড় শুরু হলে ডলারের প্রবাহ কিছুটা বাড়বে। তবে ডলার সংকট আপাতত কাটার কোনো
সুযোগ দেখছি না। আমাদের সাশ্রয় নীতি আরো জোরদার করতে হবে।”
পলিসি
রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন,
"এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট-রেমিট্যান্স ব্যালান্স হলেও পেমেন্টে ব্যালেন্স হচ্ছে না।
কারণ, এখন আমাদের অনেক পেমেন্টে বাকি পড়ে আছে। অনেক পেমেন্ট পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
ডলারের সংকটে শুধু ভোগ্য পণ্য নয়, গ্যাস, কয়লাও আমদানি করা যাচ্ছে না। এক্সপোর্ট
বেড়েছে ১০ শতাংশ, রেসিট্যান্স বেড়েছে ২ শতাংশ- এটা তেমন কিছু নয়। আমদানি কমিয়ে
আসলে রপ্তানি বাড়ানো যায় না। এটা ব্যালেন্স করতে হয়।”
তার কথা,
"গত বছর আমরা ১৪ বিলিয়ন ডলার পেয়েছি ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে। তার আগের বছর
ছিল এর চেয়েও বেশি, কিন্তু এ বছর নেগেটিভ। তাহলে পরিস্থিতি সামলাবে কীভাবে?”
তিনি
বলেন, " বাজারে আমদানি করা পণ্যের ঘাটতি শুরু হয়েছে। গমের দাম বেশি, কারণ,
ডলার সংকটে গম আমদানি করা যাচ্ছে না। চিনির দাম বেশি, কারণ, চিনি আমদানি করা
যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দাম আরো বাড়বে।”
তিনি
বলেন, "গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার টাকার সংস্থান বাড়াতে পারবে। কিন্তু
ডলার তো বাড়াতে পারবে না। টাকা তো ডলার না।
ইউএনডিপির
কান্ট্রি ইকোনমিষ্ট ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ডলার সংকট আছে, তবে এতটা প্রকট নয়
যে, পণ্য আমদানি করা যাবে না। এখন অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে। রোজাকে সামনে
রেখে যেসব পন্য আমদানির পর খালাস করা যাচ্ছে না সেগুলো দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা
করতে হবে। মানুষ রমজানে যেসব ভোগ্যপণ্যে অভ্যস্ত, সেগুলো চাইলেই বাদ দেয়া যাবে
না। মানুষের অভ্যাস হঠাৎ করে বদলানো যায় না। তাই যেকোনো উপায়ে রমজানের পণ্য
আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।”
তার কথা,
"বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোতে ডলারের সরবরাহ আরেকটু বাড়িয়ে
দেয়, তাহলে হয়ত এলসি খোলা আরেকটু সহজ হবে। ডলরের ক্রাইসিস আছে। এটা চলতে
থাকবে। তবে জানুয়ারির শেষের দিকে আইএমএফ-এর লোনটা এলে ডলারের সাপ্লাই কিছুটা
বাড়বে।”