কনকনে শীতে কাঁপছে উত্তর জনপদ
রংপুর প্রতিনিধি : শুক্রবার দিনভর উত্তরের এ জেলাগুলোতে সূর্যের দেখা মেলেনি। সেই সঙ্গে বেড়েছে হিমেল হাওয়া ও শৈতপ্রবাহ। এর ফলে দিনের বেলাও লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যান বাহনগুলো। ঘন কুয়াশার সঙ্গে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে এ অ লের শ্রমজীবী ও দরিদ্র পরিবারের মানুষগুলোর। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা প্রতি শীত মরসুমে সব সময় একটু বেশিই থাকে। শুক্রবার কুয়াশায় ঢেকে যায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলসহ শহরগুলো। ঘন কুয়াশায় দূরপাল্লার বাসসহ অন্যান্য যানবাহন দিনের বেলাও লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তারাগঞ্জের বাসস্ট্যান্ডে কথা হয়, ভ্যানযাত্রী শ্রমজীবী মোমিনুল ইসলামের (৬০)সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আইজ জার (শীত) খুব বেশি নাগছে, জামাকাপড়ও নাই খুব কষ্ট হইবে আইজ। কুয়াশাতে আস্তা দেখা যায়ছে না। জান হাতোত নিয়া কাজোত যাওছি।’
ভ্যানচালক সুকুর আলী (৪০) বলেন, ভাই গত তিন দিন থাকি ঘন কুয়াশায় দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভ্যানের লাইট জ্বেলে চলাচল করছি। বিকাল ৪টার পর কুয়াশা নামা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টা বাজলে লাইট জ্বালিয়েও কিছু দেখা যায় না। এবার ঠাণ্ডাও যেমন, কুয়াশাও তেমন।
সকাল ১০টায় তারাগঞ্জের ইকরচালী বাজারে কথা হয়, হোটেল ব্যবসায়ী আলাল মিয়ার (৪৭) সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাই যে হাট ভোর ৬টা থাকি ক্রেতা-বিক্রেতায় ভরপুর থাকে, ঠাণ্ডা আর কুয়াশার জন্যে তাক দুপুর ১২টা পর্যন্ত লোক পাওয়া যায় না। দুপুরের মধ্যে যেখানে দুই আড়াই হাজার টাকার ব্যবসা করি, যেখানে ১০টা পর্যন্ত ৩০০ টাকা বিক্রি হয়নি। মানুষ শীত কুয়াশায় বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না।
বদরগঞ্জের চিকলী নদীঘেঁষা আমরুলবাড়ী গ্রামের গৃহবধূ আসমা বেগম (৩২) বলেন, বাবা, কষ্টের কথা কি কইম ঠাণ্ডাত জীবন যায় যায়। সারা রাইত নদী থাকি হু হু করি ঠাণ্ডা বাতাস ঘরোত আসি ঢোকে। শরীর হিম হয়া যায়। ঠাণ্ডাতে হাত পাও কোকড়া নাগে। মনে হওছে দ্যাওয়া উন্দাও হয়া সাদা বাতাস আর বরফ পড়ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত রংপুর জেলার জন্য ৫৫ হাজার কম্বল বরাদ্দ হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রতি ইউনিয়নে ৪৯০টি করে বিভিন্ন উপজেলায় ৩৮ হাজার ৭১০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য রয়েছে ১৬ হাজার ২৯০টি কম্বল।
জেলা প্রশাসক ড. চিত্র লেখা নাজনীন তার নেতৃত্ব শীতবস্ত্র গত দু’দিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় রাত জেগে বিতরণ করছেন। আরও কম্বল পর্যাপ্ত আছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, আজ (শুক্রবার) রংপুরে ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখনই তাপমাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা নেই। দুইএক দিনের মধ্যে তাপমাত্রা আরও কমবে।
কুড়িগ্রাম: ঘন কুয়াশা আর তীব্র ঠাণ্ডার শুরুতেই কুড়িগ্রামে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। শুক্রবার সকালে জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গত ২৪ ঘণ্টায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমেছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপাকে পরেছে খেটে খাওয়া সাধারণ কর্মজীবী মানুষ।
মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে চারদিক। ফলে এসময় হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে হয়। এদিকে ঘন কুয়ার কারণে জেলার ট্রেন ও নৌ চলাচলে কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে দেরি করে ছাড়ছে এসব যানবাহন। শীতের তীব্রতা বাড়ার কারণে সব থেকে বেশি বিপাকে পড়েছেন নদী তীরবর্তী অঞ্চলের শিশু ও বৃদ্ধরা। শীতের কারণে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে শিশু ও বয়স্কদের। হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ধরলা নদীর তীরবর্তী এলাকার শহিদুল আলম(৩৮) বলেন, গত কয়েকদিন ধরে অত্যধিক কুয়াশা পড়ছে। সেই সঙ্গে হিমেল বাতাসে ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে। অর্থের অভাবে শীতবস্ত্রও কিনতে পারছি না।
তবে শীত মোকাবিলায় দুর্গত মানুষের সহায়তার প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আসন্ন শীতে জেলার গরিবও দুস্থদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৩৮ হাজার কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত এসব কম্বল ইতোমধ্যে জেলার ৯ উপজেলায় উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা শাখা।
এদিকে কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) তুহিন মিয়া জানান, শুক্রবার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমতাবস্থায় চলতি মাসের শেষের কয়েকটি দিন ও বছরের শুরুতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।
লালমনিরহাট: ঘন কুয়াশা ও শীতে জবুথবু তিস্তার পাড়ের ৬৩ চরের মানুষ। গত তিনদিন ধরে তীব্র শীতে বৃদ্ধ ও শিশুরা কষ্ট পাচ্ছেন। ঘর থেকে বের হতে পারছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে লালমনিরহাটে সূর্যের লুকোচুরি খেলা চললেও বেড়েছে হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীত।
এদিকে কুড়িগ্রামের রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকছে জেলার পাঁচ উপজেলা। অনেকে খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।
তিস্তা পাড়ের রোস্তম আলী (৫৭) বলেন, শীতে তিস্তা পাড়ের মানুষ বেশি কষ্ট করেন। তাই সরকারি গরম কাপড় চরের মানুষের মাঝে বিতরণ করা প্রয়োজন।
আদিতমারী উপজেলার দুরাকুটি ইউনিয়নের দিঘলটারী গ্রামের মজিদুর রহমান বলেন, গত তিনদিন থেকে সকাল বেলায় ঘন কুয়াশা পড়ছে। রাস্তাঘাট কিছুই দেখা যায় না।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ জানিয়েছেন, অন্যান্য জেলার চেয়ে লালমনিরহাটে শীতের তীব্রতা বেশি। এ পর্যন্ত এখানে প্রায় ২৫ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৫০ হাজার কম্বল বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
দিনাজপুর: দিনাজপুরসহ দেশের উত্তর জনপদে জেঁকে বসতে শুরু করছে শীত। দিনাজপুরে ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে তাপমাত্রা। সেইসঙ্গে ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে এই জনপদ।
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছে, ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা। শুক্রবার দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পঞ্চগড়: কনকনে শীতে কাঁপছে পঞ্চগড়। গত শুক্রবার সকালে শীত উপেক্ষা করেই কাজে নামেন খেটে খাওয়া মানুষ। করতোয়া নদীতে দল বেঁধে পাথর তোলার কাজ করতে দেখা গেছে শ্রমিকদের।
জানা যায়, বুধবার বিকাল থেকেই জেলার ওপর দিয়ে উত্তরের হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করে। সন্ধ্যা নামার পর প্রচণ্ড শীত অনুভূত হতে থাকে। বাতাসের কারণে রাতে কুয়াশার পরিমাণ কম ছিল। তবে বৃহস্পতিবার ভোরে কুয়াশা বেড়ে যায়। কোথাও কোথাও বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরে। সকালে সূর্যের মুখ দেখা গেলেও শীতল বাতাসের কারণে দিনভর রোদের উত্তাপ তেমন একটা অনুভূত হয়নি।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ জানান, উত্তরের হিমেল হাওয়ার কারণে বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার আগের দিনের চেয়ে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৯ ডিগ্রি কমে ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। আগামী মাসের শুরুর দিকে জেলার ওপর দিয়ে একটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলে জানান তিনি।