মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি: মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রকল্পে গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী খাতুনের বিরুদ্ধে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে । সরকারী বরাদ্দ অনুযায়ী মালামাল ও নগদ অর্থ চাষীদেরকে না দিয়ে নামমাত্র মালামাল দিয়ে দায়সারা কাজ করেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা । এতে কৃষকদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহ্রণের দাবি সুবিধাবঞ্চিত কৃষকদের।
অফিস সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের অন্যান্য জেলার মত গাংনী উপজেলাতেও ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বরাদ্দ দেয়। প্রকল্প গুলোর মধ্যে রাজস্ব প্রকল্প, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে অনাবাদি পতিত জমি ও বসত বাড়ীর আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প, বৃহত্তর কুষ্টিয়া- যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প ও এনএটিপি প্রকল্প ও এসএমই উল্লেখযোগ্য।
গাংনী উপজেলায় রাজস্ব প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৩০ জন চাষীকে অধিক ফলনশীল ভুট্টা চাষের প্রদর্শনী প্লটে ব্যয় বরাদ্দ প্রায় ৯ লাখেরও অধিক টাকা। এতে ১৩০ বিঘা জমির জন্য ১৫টি আইটেমে প্রতি বিঘা জমিতে মোট ৬ হাজার ৯ শত ৬০ টাকা করে সরকারিভাবে বরাদ্দ রয়েছে।
অথচ, এরমধ্যে নামমাত্র মালামাল সরবরাহ করলেও চাষীদেরকে দেওয়া হয়নি আন্তঃ পরিচর্যা খরচ ১ হাজার টাকা, পরিবহন খরচ ৩ শত টাকা, আনুষঙ্গিক ব্যয় ৩ শত টাকা ও কৃষক ব্রিফিং ভাতা ৫ শত টাকা। অর্থাৎ বিঘা প্রতি মোট ২ হাজার ১ শত টাকা ।
সেই মোতাবেক ভুট্টার বরাদ্দে ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা কৃষকদেরকে না দেওয়ায় কৃষকদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। শুধুমাত্র ভুট্টা চাষে নয়, একই প্রকল্পে গম, সরিষা, বোরো ধান ও মসুরিসহ অন্যান্য ফসলের সরকারী বরাদ্দেও ঘটেছে একই রকমের ঘটনা।
এ সকল বরাদ্দে উপজেলার প্রায় ১ হাজার ৫ শত জন কৃষক সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি।
উপজেলার চিতলা গ্রামের গম চাষী রমজান আলীর ছেলে আতিয়ার রহমান জানান, তিনি কেবলমাত্র ১০ কেজি টিএসপি, ১০ কেজি পটাশ ও ১৫ কেজি বীজ এবং একটি সাইনবোর্ড পেয়েছেন।
তাছাড়া, নগদ কোন টাকা তিনি পাননি। একই কথা জানিয়েছেন ধানখোলা ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের ভুট্টা চাষী ফজলুল হকের ছেলে পিন্টু এবং নিত্যানন্দপুর গ্রামের সরিষা চাষী ওমর মন্ডলের ছেলে কাজল মন্ডল।
চাষীরা জানেন না সরকারি বরাদ্দে তাদের জন্য কি রয়েছে। ক্রমাগত কারচুপি ও অবহেলার কারণে চাষীরা কৃষি অফিসের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। তাছাড়া নামমাত্র যা দেওয়া হচ্ছে সেটুকু সময় মত না পাওয়া, কৃষি অফিসে আসলে কৃষকদের সাথে অফিস সহায়ক ও কর্মকর্তাদের অসদাচরণ, কৃষকদেরকে দিনের পর দিন হয়রানি করা বিষয়গুলো তো নিত্য দিনের ব্যাপার বলেও জানিয়েছেন একাধিক চাষী।
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে অনাবাদি পতিত জমি ও বসত বাড়ীর আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্পে প্রতি দেড় শতক জমিতে ৩ হাজার ৭ শত টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেখানে কেবলমাত্র ৫০ গ্রাম করে লাল শাক, পালং শাক, পুইশাক, ঢেঁডস ও লাউ বীজ মোট ১৫০ টাকাসহ ১০ টাকার পেঁপে চারা, ২০ টাকার পেয়ারা তারা ও ২০ টাকার লেবু চারা দিয়ে ২ শত টাকা ও ২ শত টাকা মূল্যের একটি সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। সর্বসাকুল্যে মাত্র ৪০০ টাকার মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে। অর্থাৎ বরাদ্দের সবটুকু দেয়া হয়নি।
বৃহত্তর কুষ্টিয়া- যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ওল প্রদর্শনীতে ৪৩ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু উক্ত প্রদর্শনীর জন্য মনোনীত কৃষক উপজেলার চিতলা গ্রামের আহম্মদ আলীর ছেলে মহিউদ্দিন জানান তাকে কেবলমাত্র ১৭ হাজার ৫ শত টাকা মূল্যে মানের বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে।কোন নগদ অর্থ প্রদান করা হয়নি।
উপজেলার ধানখোলা ইউনিয়নের চিতলা গ্রমের রমজান আলীর ছেলে চাষী আতিয়ার রহমান, একই ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে পিন্টু, নিত্যানন্দপুর গ্রামের ওমর মন্ডলের ছেলে কাজল মন্ডলসহ একাধিক কৃষক জানান, সব খরচ কৃষি অফিস বহন করার কথা বলে চাষী নির্বাচন করেন। কিন্তু জমির চাষ ও পানির খরচ চাষীকেই বহন করতে হচ্ছে। আবার জমির রোপণ খরচও চাষীকে বহন করতে হচ্ছে। বেশিরভাগ খরচই যদি তাদের বহন করতে হয়, তাহলে চাষীদের অনুকূলে সরকারের বরাদ্দকৃত লাখ লাখ টাকা কোথায় যাচ্ছে? বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি সুবিধাবঞ্চিত চাষীদের।
এ বিষয়ে ঐ অর্থবছরে ধানখোলা ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ- সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, চাষীদের জন্য সরকারি-বরাদ্ধ কি রয়েছে এবং তাদেরকে কি দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি কেবলমাত্র উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার নিকট চাষীর নাম, ঠিকানা,ও মোবাইল নাম্বার উল্লেখপূর্বক তালিকা জমা দেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিজ হাতেই সমস্তকিছু করে থাকেন। একই কথা জানিয়েছেন জোড়পুকুর বøকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাফর কুদ্দুস ও তেঁতুলবাড়ীয়া বøকের উপ- সহকারী কৃষি কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুর রউফকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারী বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ কত ? চাষীদের কতটুকু দেয়া হয়েছে ? তাছাড়া মাঠ দিবসের লক্ষ্যমাত্রা কত এবং কতটা বাস্তবায়ন করা হয়েছে ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানেন।বিসিআইসি ও বিএডিসি ডিলারের নিকট থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে তাদেরকে যথাযথভাবে মনিটরিং না করে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুর রউফ এর বিরুদ্ধে।
এব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কর্মকর্তা লাভলী খাতুন বলেন ২০২১- ২০২২ অর্থবছরে সরকারী বিভিন্ন প্রকল্পের সমস্ত সরকারী সুবিধা মনোনীত চাষীদেরকে ইতোমধ্যে প্রদান করা হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে কতটুকু করে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে ? এ বিষয়ে তিনি সঠিক তথ্য জানাতে পারেন নাই। বরাদ্দের অর্থ বছর পেরিয়ে গেলেও মনোনীত চাষীরা তাদের নগদ টাকা অদ্যাবধি কেন পাই নাই ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সমস্ত চাষীদের বরাদ্দকৃত টাকা তিনি উত্তোলন করে তার ব্যাংক একাউন্টে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। বিকাশের মাধ্যমে তাদেরকে ফেরত দেওয়া হবে। অর্থ বছর পেরিয়ে দুই মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সরকারি বরাদ্দের টাকা চাষীদের মাঝে বিতরণ না করে ব্যাংকের সংরক্ষণ করে রাখাটা কতটা আইনসিদ্ধ? এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শামসুল আলম বলেন, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বিভিন্ন প্রকল্পের মনোনীত চাষীদের মাঝে সরকারি বরাদ্দ ও কৃষি অফিসের আওতায় মাঠ দিবসের লক্ষমাত্রা ও অর্জন বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানেন না বিষয়টি সঠিক না। তাছাড়া চাষীদের সরকারি বরাদ্দের টাকা তিনি যদি চাষীদের মাঝে বিতরণ না করে দুই মাস যাবৎ একাউন্টে রেখে দেন তাহলে চরম অনিয়ম করেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।