গার্ডার দুর্ঘটনা: ‘সেফটি ইঞ্জিনিয়ার’ এর কোন কারিগরি শিক্ষা নেই
তার।গার্ডার চাপায় পাঁচজনের মৃত্যুর মামলায় জুলফিকারকে গ্রেফতারের পর র্যাব জানায়, তার কোনো কারিগরি শিক্ষা নেই। তিনি এসএসসি পাশ করেই এত বড় প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পান।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
১৫ আগস্ট গার্ডারচাপার ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা হলেন- ক্রেনচালক মো. আল আমিন হোসেন ওরফে হৃদয় (২৫), রাকিব হোসেন (২৩), দুর্ঘটনাস্থলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), হেভি ইক্যুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তুষার (৪২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) ও মো. মঞ্জুরুল ইসলাম (২৯)।
গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথে বিশেষ লেনের মাধ্যমে বাস চলাচলের জন্য এক দশক আগে বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।মূল নির্মাণকাজের ঠিকাদারি পায় চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান- চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো–অপারেটিভ। গার্ডার দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সিজিজিসির নির্মাণাধীন অংশে।
র্যাবের কমান্ডার আল মঈন বলেন, সিজিজিসির ‘সেফটি ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে ৩৯ বছর বয়সী জুলফিকার ২০২১ সালে নিয়োগ পান। অথচ তিনি এসএসসি পাশ।এত বড় প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার মত কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ তার নেই। প্রকল্পের বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তরার আজমপুর এলাকা পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।দুর্ঘটনার দিনে ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী বসাননি। গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত লোকও নিয়োগ করেননি।
পাঁচ বছরের এ প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায়- তা চরম গণভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।প্রকল্পের আকার এখন ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়ালেও র্যাবের তথ্য বলছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিয়েই খরচ কমানোর চেষ্টা করে গেছে। দুর্ঘটনাস্থলে যে ক্রেনটি ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেটির বয়স অন্তত ২৬ বছর।
মঈন বলেন, ক্রেনটি ছিল ফিটনেসবিহীন। আর সেটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী (হেলপার)। হেলপারের কোনো লাইসেন্সও ছিল না। তার নাম রাকিব হোসেন। আর বাইরে থেকে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল ক্রেনচালক আল আমিন। ক্রেনচালক আল আমিনেরও ভারী ক্রেন চালানোর লাইসেন্স ছিল না।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ক্রেন দিয়ে গার্ডার সরানো হচ্ছিল সেটি ছিল অনেক পুরাতন। এর ধারণ ক্ষমতা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টন। আর গার্ডারের ওজন ছিল ৬০ থেকে ৭০ টন। গার্ডার তোলার কাজ করার সময় দুটি ক্রেন থাকার কথা থাকলেও ছিল একটি। তাও আবার দুর্বল ক্রেন। থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার তুষার ক্রেনের ভাড়া চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।
র্যাব জানায়, গ্রেফতার রুহুল ২০১০ সালে এবং গ্রেফতার তুষার ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স ছাড়া অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ প্রদান করে। এছাড়াও এই ক্রেনের ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল সর্বশেষ ২০২১ সালে। ২০২২ সালে ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি।
মঈন বলেন, গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দিন রোডে বিকাল সোয়া চারটায় নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে প্রাইভেটকারের ওপরে পড়ে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। দুর্ঘটনার পরবর্তীত দ্রুততম সময়ে র্যাব সদর দপ্তরের উদ্ধার টিম ও র্যাব-১ এর একটি দল সর্বপ্রথম উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ৪ ঘণ্টাব্যাপী উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। এ সময় র্যাবের সহায়তায় অন্য একজন ক্রেন অপারেটর নিয়ে এসে গার্ডার উচু করে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি এবং নিহতদের উদ্ধারে সহায়তা করা হয়। এ দুর্ঘটনায় ভিকটিম পরিবারের পক্ষ থেকে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় অবহেলাজনিত কারণে একটি মামলা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি) তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে প্রজেক্টের গার্ডার উত্তোলনের কাজ চলাকালীন এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনায় ঘাতক ক্রেনের চালক/অপারেটর মো. আল আমিন ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
মঈন বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যার স্বত্বাধিকারী গ্রেফতার ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন গ্রেফতার আজহারুল ইসলাম মিঠু। ভারী যন্ত্রপাতি ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়াও প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের আগে কখনো এ ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন না। ট্রাফিকম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলী প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ও হেভি ইক্যুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন। সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট অফিসার মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব জানায়, ঘাতক ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিনের হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ২-৩টি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেন তিনি। ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। গ্রেফতার রাকিব ৩ মাস আগে এই প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার ক্রেন চালনা করার কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার দিনে আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালনা শুরু করেন। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলনের জন্য ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ওপর ছিটকে পড়ে এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিটপ্রাপ্ত হয়। গার্ডার বহনের ক্রেন এ প্রতিষ্ঠানের কাছে না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর ও হেলপারসহ এ ক্রেনটি মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকনের স্বত্বাধিকারী গ্রেফতার ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন গ্রেফতার মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করছিলেন। এছাড়াও গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেডের মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেন সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেফতার রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার গ্রেফতার তুষার ক্রেনের ভাড়া প্রদান, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ, ক্রেনগুলোর ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। গ্রেফতার রুহুল ২০১০ সালে ও তুষার ২০১৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছাড়া অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ প্রদান করেন।
এছাড়াও ক্রেনের সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল সর্বশেষ ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি। রুবেল ৩ মাস আগে ও আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিস ট্রাফিক ম্যান হিসেবে যোগদান করেন। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তাদের কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা দুর্ঘটনাস্থলে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিল বলে জানান মঈন।