সিলেটে
বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষ
দক্ষিণ সুরমা প্রতিনিধিঃ
বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষ
ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন। কৃষষকেরা রোদের অভাবে কাটা ধান ও
গোখাদ্য শুকাতে পারছেন না। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২৩ জুন পর্যন্ত সিলেটে
বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। তবে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে। সিলেটের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ
সাইয়িদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টি কমছে না। তাই পাহাড়ি ঢল
অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে গতকাল দুপুরে সিলেট নগরীর কয়েকটি
আশ্রয়শিবির পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন
ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুল হক। তারা আগামী বর্ষার আগে
সিলেটে সুরমা, কুশিয়ারা নদী খননের আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে
খুবই আন্তরিক।
সিলেট শহরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ
রূপ নিচ্ছে। পর্যটন নগরীর অনেক বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। অফিস ও দোকানপাটে
পানি ঢুকেছে। সুরমা নদী উপচে মহানগরীর বিভিন্ন পাড়ামহল্লায় পানি থৈথৈ করছে। নগরীর
মাছিমপুরের অনেক বাসার উঠানে, ঘরে হাঁটু পানি। শুঁটকিবাজারের রাস্তায় কোমর পানি। তালতলা
এলাকায় বিরাজ করছে হাঁটুসমান পানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আঙিনায় পানি। উপশহর, সোবহানিঘাট,
কালিঘাট, ছড়ারপাড়, শেখঘাট, নবাব রোড, তপোবনসহ পুরো এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
ঐ সব এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শহরের কাছে সুরমা নদী পানিতে টইটম্বুর,
তাই ড্রেনের পানি নামছে না। পাড়ায় পাড়ায় ড্রেনের বর্জ্য অলি-গলির বাসায় ঢুকে এক অস্বস্তিকর
অবস্থা বিরাজ করছে।
বিপর্যস্ত
হয়ে পড়েছে সিলেটের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। দক্ষিণ সুরমা, উপশহরসহ কয়েকটি এলাকার
বিদ্যুতের সাব-স্টেশন পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে গত তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ
সরবরাহ। এছাড়া বাড়িঘরে পানি উঠে যাওয়ায় কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, কোম্পানিগঞ্জ,
জৈন্তাপুর, সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান
প্রকৌশলী আব্দুল কাদির বুধবার বিকালে ইত্তেফাককে বলেন, কিছু জায়গায় সাব-স্টেশনের
যন্ত্রপাতি পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক জায়গার বাসাবাড়ির মিটার পর্যন্ত ডুবে
গেছে। এ কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। পানি না কমলে এটি স্বাভাবিক হবে না। তিনি
বলেন, দক্ষিণ সুরমা, উপশহরসহ বিভিন্ন এলাকার ৫০ সহাস্রাধিক গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধা
থেকে বঞ্চিত।
তার ওপর
বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল ফোনও চার্জ দিতে পারছি না। ফলে জরুরি প্রয়োজনেও কারো
সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অনেক স্হানে খাবার পানির সংকট। সবচেয়ে সমস্যা
হচ্ছে বাথরুম ব্যবহারে। সিলেটের দক্ষিণসুরমা সাব-স্টেশনের যন্ত্রপাতির নিচে পানি
থাকায় আলমপুরস্হ বিভাগীয় অফিস, বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস, ডিআইজি অফিস, বিভিন্ন
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ নাই গত তিন দিন ধরে। পাসপোর্ট অফিসের
জেনারেটরও বিকল হয়ে গেছে।
ভারতের বরাক নদী ফুঁসে উঠে সিলেটের সুরমা,
কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদীর পানি বেড়েছে। গতকাল সকালে জকিগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের
রহিমপুর পাম্প হাউজের কাছে কুশিয়ারা নদীর তীরে ‘ক্রস ড্রাম’ ভেঙে গেছে। তবে পানি
উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম ইত্তেফাককে
জানান, এই পানি পাম্পের সাহয্যে রহিমপুর খাল দিয়ে বের করা গেলে শুষ্ক মৌসুমে ফসলে
সেচ দেওয়া যাবে।
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত
পরিচালক জানান, গতকাল বুধবার পর্যন্ত সিলেটের ১৭টি উপজেলায় ২ হাজর ৩৭৯ হেক্টর
বোরো, ১ হাজার ৩৪২ হেক্টর আউষ বীজতলা, ১ হাজার ৫৪ হেক্টর সবজি ও ৭০ হেক্টর
বাদামখেত নিমজ্জিত হয়েছে। অন্যদিকে উপদ্রুত অঞ্চলে সড়কযোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ায়
জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে অনেক স্হানে। নিত্যপণ্যের স্বল্পতা ও দাম বেড়েছে।
সিলেটে ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র
সিলেটে বন্যাকবলিতদের আগে ১২৯ টন চাল ও ১ হাজার
প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়। নগরীর বর্ধিত এলাকা ও নিম্নাঞ্চলে
পানিবন্দি পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে
নগরবাসীর দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্হিতিতে নগরীর সাতটি ওয়ার্ডে ১৬টি
আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে সিটি করপোরেশন। কানাইঘাট উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের বন্যা
পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গোয়াইনঘাটের ১২টি ইউনিয়জন্য ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মো. মুজিবর রহমান জানান। তিনি বলেন, সব আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের ব্যবস্হাও করা হয়েছে। ইউএনওদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে। তিনি জানান, বন্যাকবলিতদের জন্য আরেক দফায় ১০০ টন চাল ও ৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর নের ৩ লক্ষাধিক মানুষ
পানিবন্দি। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান সড়কগুলো বিছিন্ন হয়ে
পড়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী
ইমরান আহমদের নির্দেশনায় সিলেট জেলা প্রশাসন প্রাথমিকভাবে গোয়াইনঘাটে বন্যায়
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২৪ মেট্রিক টন জিআর চাল বানভাসি মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়।
সেখানে ৪৭টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্ত্তত করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি ঢলে
সুনামগঞ্জের নদীতীরবর্তী এলাকা ও নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সুরমা নদীর পানি গতকাল সকালে পৌর শহরের
ষোলঘর পয়েন্টে বিপত্সীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুনামগঞ্জের
পৌর শহরের উত্তর আরপিননগর, সাহেববাড়ী ঘাট, ষোলঘর, বড়পাড়া, পুরানপাড়া এবং
বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজরসহ চারটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে চরম ভোগান্িততে পড়েছে লাখো মানুষ। অনেক বাড়িঘরেই পানি।
কেউ আবার কষ্টের ফলানো বোরো ধান যাতে পানিতে ভেসে না যায়, সেগুলো রাস্তার
কিনারায় রেখেছেন। ঢলের পানিতে রান্নার চুলাও পানির নিচে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর
হোসেন বলেন, ছাতকে তিনটি ও দোয়াবাজারে একটি স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে ২০ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ টাকা জিয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।