স্টাফ রিপোর্টার : দেশে করোনাতে দৈনিক রোগী শনাক্ত, মৃত্যু এবং শনাক্তের হার-সবই কমছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশে যদি টানা দুই সপ্তাহ দৈনিক শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকে তাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বলে ধরা হবে। এদিকে দেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ে স্বস্তি এসেছে। তবে এই স্বস্তিতে তুষ্ট হয়ে স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। মানুষ মাস্ক পরছে না, শপিং মল, গণপরিবহণ, বেসরকারি অফিস, রেস্টুরেন্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অভিভাবকদের ভিড়, হাসপাতালসহ কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। স্বস্তিতে ভুগে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে আবার বিপর্যয় আসতে একটুও সময় লাগবে না। তার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর উদাহরণ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল ভিয়েতনাম। কিন্তু বর্তমানে যে কয়েকটি দেশে সংক্রমণ বেশি, তার মধ্যে ভিয়েতনাম একটি। আমেরিকাতেও সংক্রমণ অনেক বেশি। সংক্রমণের এই নিুমুখী হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিকার ওপর জোর দিয়েছেন তারা। সঙ্গে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানার এই ঢিলেমি ত্যাগ করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেবল টিকার ওপর নির্ভর করলে সেটা হবে বোকামি।
গত বৃহস্পতিবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং নতুন শনাক্ত ছিল গত চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৪ জন। এর আগে ২৭ মে একদিনে ২২ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেই সঙ্গে একইদিনে করোনাতে শনাক্ত হন এক হাজার ১৪৪ জন। এর আগে গত ২২ মে এক হাজার ২৮ জন শনাক্ত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। সেই হিসাবে করোনায় দৈনিক শনাক্তও গত চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। একইদিনে দেশের আট বিভাগের মধ্যে তিন বিভাগেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি। তবে তার পরের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর করোনাতে নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যু কিছুটা বাড়লেও তার আগের দিনের তুলনায় শনাক্তের হার কমেছে। গত শুক্রবার করোনায় রোগী শনাক্তের হার চার দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ছয়মাস পর করোনাতে রোগী শনাক্তের হার টানা চারদিন ধরে পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর আগে গত এক আগস্ট দৈনিক শনাক্তের হার ১০ শতাংশে নেমে আসে। সেদিন শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। যা গত ৪ জুনের পর সর্বনিম্ন।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্ত নিম্নমুখী প্রবণতার দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আগস্ট মাসে নতুন শনাক্ত কমে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন অধিদফতর আয়োজিত বুলেটিনে বলেন, বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। তবে তার মানে এই নয় যে করোনা চলে গেছে মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, এখন তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, মাস্ক পরছেন না। কিন্তু সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিদিনকার করোনা তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় জুলাই দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রথম ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অতিসংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তা-বে জুলাই ছিল করোনা মহামারিকালে ভয়ঙ্কর। যদিও তার আগের মাস জুন থেকে দৈনিক শনাক্তের হার ওঠে যায় ২০ শতাংশের ওপরে। তবে জুলাইতে প্রায় প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুতে তার আগের দিনের রেকর্ড ভাঙ্গতে থাকে। এরিমধ্যে দেশে করোনাকালে একদিনে সর্বোচ্চ (গত ২৮ জুলাই) রোগী শনাক্ত হয় ১৬ হাজার ২৩০ জন। শনাক্তের হার ওঠে যায় ৩২ শতাংশের বেশি। ভয়ঙ্কর জুলাই শেষ হবার পর তার রেশ চলতে থাকে আগস্ট মাস পর্যন্ত।
গত ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৩৮ দিনের মধ্যে ৩০ দিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি ছিল। আর করোনাকালে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় আগস্ট মাসের দুইদিন। গত ৫ এবং ১০ আগস্ট একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে আগস্টের প্রথম দিক থেকে রোগী শনাক্তের হার ক্রমেই কমছে। আর চলতি মাসে সংক্রমণের হার কমে এসেছে পাঁচের নিচে। সংক্রমণ কমে আসায় সরকার কঠোর বিধিনিষেধ তুলে দেয়। খুলে দেয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সংক্রমণের হার কমাতে স্বস্তি রয়েছে, তবে যেভাবে চলাফেরা করছে মানুষ তাতে আবারো আমার ভেতরে সাংঘাতিক আশঙ্কা রয়েছে। করোনা শেষ হয়ে যায়নি। এখনো সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে, সংক্রমণ চলছে। আর যে কোনো সংক্রমণশীল রোগের চরিত্রই হচ্ছে যে কোনো সময় এটা আবার বেড়ে যেতে পারে। কেননা, এর মধ্যে হয়তো এই ভাইরাসের স্ট্রেইন বদলাবে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে।
তিনি বলেন, তাই আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি ভুলে যাই তাহলে হঠাৎ করে আবার বেড়ে যাবে, তখন আবার সেই আগের অবস্থাতে ফেরত যাবো আমরা। আবার অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার, আইসিইউ-র বেড পাওয়া যাবে না, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে রোগী মারা যাবে, হাসপাতালের বারান্দায় রোগীরা পড়ে থাকবে। তিনি আরো বলেন, ‘মৌলিক তিন স্বাস্থ্যবিধির ভেতরে প্রথমেই রয়েছে মাস্ক পড়া। কিন্তু বর্তমানে মাস্কের ব্যবহার কোথাও নেই। ভয় পাচ্ছি- আবার নাকি ২০২০ সালের জুন-জুলাইতে যেটা হয়েছিল, ২০২১ সালের জুন-জুলাইতে যেরকম আচরণ দেখলাম করোনা ভাইরাসের, তার আবার পুরনো চিত্র দেখতে হয় কিনা। স্বাস্থ্যবিধি ভুলে গেলে তার মাশুল দিতে হবে-এটা যেন আমরা ভুলে না যাই মন্তব্য করে আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সবাইকে মাস্ক পড়তে হবে আর সুষ্ঠু, সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে টিকা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে।
মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা যে কোনও সময়েই রয়েছে বলেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বহুদেশে সংক্রমণ অনেক বেশি, গত ২৩ সেপ্টেম্বর আমেরিকাতে এক লাখের বেশি মানুষ শনাক্ত হয়েছে, ভিয়েতনাম কিংবা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আমাদের পার্শ্ববর্তী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনে প্রতিদিন অনেক মানুষ শনাক্ত হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় ভাইরাসের পরিবর্তন হতে পারে। এটা অনবরত পরিবর্তনশীল ভাইরাস।
ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ভ্যারিয়েন্ট বদলাতে পারে, সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে। এখনো অসতর্ক হবার কোনো সুযোগ নেই, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাবধানে এবং সচেতন থাকতে হবে। সামাজিক অবস্থার চেয়েও ব্যক্তিগত সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান স্বস্তি নিয়ে যদি স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেমি দেয়া হয় তাহলে আবারো বিপর্যয় আসতে পারে। আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে টিকা নেয়ার ওপর জোর দেন ডা. এ এস এম আলমগীর। যাদের সুযোগ রয়েছে, তাদের অবশ্যই টিকা নিতে হবে, টিকাও সংক্রমণ কমার অন্যতম কারণ, যদিও একমাত্র নয়। টিকার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে ধরে রাখা সম্ভব, নয়তো যে কোনো সময় এটা বেড়ে যেতে পারে, বলেন তিনি।