জাহাঙ্গীর খান বাবু : নারী পাচারকারীদের ভয়াবহ নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। তারা টিকটক, লাইকি, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার, ডিসকড, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির অ্যাপস ব্যবহার করে পাচারের জন্য নারীদের সংগ্রহ করছে। নিজস্ব দালাল নিয়োগ করেও নানা কৌশলে নারীদের পাচার করে দিচ্ছে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, কাতার, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এরকম ৩০টি বা তারও বেশি চক্র সারাদেশে বিস্তৃত রয়েছে। আবার আদম পাচারকারী দালালদের কিছু চক্র নারীদের গৃহপরিচারিকার চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কত নারী পাচার হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পুলিশ বা কোনো বেসরকারি সংস্থার কাছে নেই। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। বছরে দেশ থেকে ২০ হাজার নারী, কিশোরী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে।
অপর এক হিসাব অনুযায়ী কয়েক বছরে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্যান্য দেশে ৫০ হাজার নারী পাচার হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের বরাতে একটি বেসরকারি সংস্থা জানিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ বছরে ৫০০ নারী ও আট বছরে ১ হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। ২০২০ সালে দেশে মানব পাচারের যে ৩১২টি মামলার বিচার হয়, সেগুলোর ২৫৬টি ছিল নারী পাচার ও যৌন সহিংসতা-সংক্রান্ত। এ ছাড়া গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার নারী সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে গেছে। যাদের বড় একটি অংশ যৌন নিপীড়নসহ নানামুখী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্যমতে, নারী পাচারকারী সিন্ডিকেটের ভয়াহব নেটওয়ার্ক দেশজুড়ে বিস্তৃত। তারা কিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব এজেন্ট বা দালালের মাধ্যমে পাচারের জন্য নারী সংগ্রহ করে। সমপ্রতি তাদের কর্মকা-ে নতুন সংযোজন হিসেবে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সারাদেশে ২৫ থেকে ৩০টি বা তারও বেশি আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট বা চক্র নারী পাচারে জড়িত। এসব চক্রে পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে ৭-৮টি চক্রকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছি। এ চক্রগুলো পৃথক পৃথক কৌশলে দেশের বাইরে নারীদের পাচার করে। এক চক্রের সঙ্গে আরেক চক্রের যোগাযোগ কিছু ক্ষেত্রে থাকে আবার অনেক ক্ষেত্রে থাকে না। নারী পাচারকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার প্রক্রিয়া একটি কন্টিনিউ প্রসেস।
তিনি আরো বলেন, টিকটক হৃদয় ও তার বাহিনী কর্তৃক ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে এক বাংলাদেশি তরুণীকে ভয়াবহ নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর আমরা এ চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি। এমনকি চক্রের নারী সদস্যদেরও গ্রেফতার করেছি। সমপ্রতি নারী পাচারে নতুন একটি ডাইমেনশন এসেছে। সেটি হচ্ছে- পাচার চক্রের সদস্যরা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টিকটক, লাইকিসহ বিভিন্ন অ্যাপসে আলাদা আলাদা গ্রুপ গঠন করে। সেখানে তারা টিকটক শো করা, লাইকি শো করা, পুল পার্টি করা নামে এবং কিশোর-তরুণীদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেয়াসহ নানাভাবে প্রলুব্ধ করে বিদেশে নিয়ে যায়। বিদেশে নিয়ে নারীদের মাদকে আসক্ত করার পর বিভিন্ন নির্যাতন করে অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। পরে বিভিন্ন যৌন পল্লীতে বিক্রি করে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় দালাল চক্রের মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন ধরনের টোপ দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে দেয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, টিকটক লাইকিসহ কিছু ক্ষতিকর অ্যাপস আমরা বন্ধের বিষয়ে বলেছি। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালত কিছু গেমস নিষিদ্ধ করেছে। আমরা একা চেষ্টা করলে হবে না। এ জন্য অভিভাবকদেরও সচেতনতা দরকার ও সমাজে প্রতিনিধি যারা আছেন যাদের কথা মানুষ শোনেন তাদেরও সোচ্চার হতে হবে। এতে এ জাতীয় অনৈতিক অপরাধ সমাজে অনেক কমে যাবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিনিয়ত বড় একটি সংখ্যায় নারী ও শিশু নিখোঁজ হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে জুন মাসে চাঁদপুর জেলা থেকে ৪১৩ জন নারী নিখোঁজ হয়। জেলার আট থানায় ছয় মাসের জিডি ও মামলা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ৩৯৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ১৯ জনকে উদ্ধার করা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এদের কেউ কেউ পাচারের শিকার হয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ পরিদর্শক বলেন, এসব নারী ও কিশোরীর বেশির ভাগই ঘর ছেড়েছেন ফেসবুকসহ তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে। একই সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার পাঁচটি থানায় ২১ নারী-শিশু অপহরণের মামলা হয়। যার মধ্যে পাঁচটি মামলার ভিকটিম উদ্ধার করা যায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, টিকটক, লাইকি ও ফেসবুকসহ তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে ভয়ানকভাবে নারী পাচার কার্যক্রম চলছে। বিষয়টি বুঝতে আমাদের কিছুটা দেরি হয়েছে। আমরা মনে করেছিলাম, এই অ্যাপগুলো শুধু আনন্দ বিনোদনের জন্য এবং সেগুলো দুনিয়াব্যাপী চলছে। কিন্তু পরে দেখলাম, তরুণদের একটা গ্রুপ এসব অ্যাপের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে ভয়ানক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সমপ্রতি রাজধানীর হাতিরঝিল থানা এলাকা থেকে ভারতে পাচারের শিকার হন তোহা আক্তার বীথি নামে ১৫ বছরের এক তরুণী। বেগুনবাড়ীর বাসিন্দা ওই তরুণীর বাবা মো. মনা মেয়েকে ফেরত পাওয়ার আশায় হাতিরঝিল থানায় গত ৮ জুলাই মামলা করেন। বীথির মা বলেন, ‘আমার মেয়ে মাঝেমধ্যে হাতিরঝিল এলাকায় হাঁটতে যেত। সেখানে ইসরাত নামে এক মেয়ে আসত। তারা কয়েকজন মিলে টিকটক ভিডিও বানাত। আমার মেয়েকেও টিকটক বানাতে বলত। ইসরাত নিজের বাড়ি জিঞ্জিরায় বলে পরিচয় দেয়। ইসরাত আমার মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বিউটি পারলারে কাজ দেয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করে টিকটক হৃদয় বাবু ও তার দলের হাতে তুলে দেয়।
কিছু দিন গৃহপরিচারিকা হিসেবে সৌদি আরবে যাওয়া এক নারীর প্রতি ভয়ানক নিপীড়নের ভিডিও প্রকাশ হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পরে ওই নারীকে উদ্ধার করে দেশে আনা হয়। নিপীড়নের শিকার ওই নারীর নাম সুমী আক্তার। তিনি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বাসিন্দা। এক দালাল তাকে সৌদি আরবের রিয়াদের একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ দিয়ে নিয়ে যায়। ওই বাসায় চার মাস কাজ করার পর সৌদি পরিবারটি তার কপিলের মাধ্যমে ১২ হাজার রিয়ালে ওমানের সীমান্তবর্তী নাজরান শহরের বাসিন্দা আরেকটি পরিবারের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সুমীকে ভয়ানক নিপীড়ন করত। সুমীর আপলোড করা একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তাকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে আনা হয়।
জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গাইবান্ধায় অপহরণ ও নিখোঁজের মামলা হয়েছে ৮২টি। গাজীপুর জেলার পাঁচ থানায় ২৪৮ নারী ও শিশু নিখোঁজের মামলা হয়েছে। এ ছাড়া মানব পাচারের মামলা হয়েছে দুটি। মেহেরপুরের তিন থানায় ও নারী-শিশু অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে ৪২টি। একই সময় ময়মনসিংহ জেলায় ৪৭৪ নারী ও শিশু নিখোঁজের তথ্য জানিয়ে জিডি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে মোবাইল ফোনে প্রেম পরে তরুণীকে বিয়ে ও মোটা অংকের বিনিময়ে স্ত্রী এবং শ্যালিকাকে ভারতে পাচারের তথ্য উদঘাটন করে র্যাব। এ অভিযোগে ইউসুফ মিয়া ও তার সহযোগীকে গ্রেফতারের পর র্যাব-১৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু নাঈম মো. তালাত বলেন, ‘মানব পাচারকারীদের এ চক্রটি ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে দীর্ঘদিন থেকে ভারতে নারী পাচার করে আসছে।
জেলা পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান জানান, চলতি বছরে নারী-শিশু নিখোঁজ অপহরণ মামলার সংখ্যা ৯২টি। সাধারণ ডায়েরি হয়েছে ৪৭৪টি। নিখোঁজের মধ্যে ফিরে এসেছেন ৪৩৩ জন। এখন পর্যন্ত সন্ধান মেলেনি ৪১ জনের। জেলার ১৩ থানার মধ্যে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে সাতটি। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে নেত্রকোনায় অপহরণ মামলা হয়েছে ৬৪টি এবং নিখোঁজের ডিজি হয়েছে ৭৪টি।
জেলা পুলিশের ভাষ্যমতে, অধিকাংশ ঘটনাই মোবাইল ফোনে বা ফেসবুকে প্রেম করে পালানো সংক্রান্ত। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যহার করে নারী পাচার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, টিকটক, লাইকিসহ তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে নারী পাচার একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির নির্ভরতা যত বাড়বে; এ ধরনের অপরাধের ঝুঁকি তত বাড়বে। এর বড় কারণ হচ্ছে কিশোরী বা তরুণীদের এসব অ্যাপ থেকে অর্থ আয়ের স্বপ্ন দেখানো হয়। তারা বিভিন্ন গ্রুপে অ্যাড হয়ে আড্ডা দিতে গিয়ে বা অন্যদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে ভিকটিমে পরিণত হয়। এ ধরনের অপরাধ রোধে এই অ্যাপগুলো সুপারভিশন করা জরুরি। তাছাড়া কারা কী ধরনের কন্টেন্ট অ্যাপে আপলোড করছি সেটিও দেখা দরকার। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচিত সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো। যাতে কোনো নারী সহজেই সীমান্ত পার হয়ে অন্য দেশে যেতে না পারে।