স্টাফ রিপোর্টার : দিন দিন দেশে খাদ্যশস্যের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, সে হারে উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে বিগত কয়েক বছর ধরেই খাদ্যে (চাল ও গম) আমদানিনির্ভরতা বেড়ে চলেছে। এক দশক আগেও দেশে আমদানিনির্ভরতার হার এক অংকের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ছিল। কিন্তু ৬ বছর ধরে তা দুই অংকের ঘরে রয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তা বেড়ে ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকলেও প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সম্ভাবনার অপর্যাপ্ত ব্যবহার, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে ক্রমেই দুরূহ হয়ে উঠছে খাদ্যশস্যে স্থিতিশীল স্বয়ম্ভরতার লক্ষ্য অর্জন। কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সংশ্লিষ্ট সূত্রে েএসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত কয়েক বছর ধরেই খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা দেখা যাচ্ছে। চালের ক্ষেত্রে ওই প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও গমে নেতিবাচক। বর্তমানে যেটুকু উৎপাদন বাড়ছে তা ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। ফলে ঘাটতি পূরণে আমদানিতে বাড়াতে হচ্ছে এবং ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে। সাধারণত খাদ্যশস্যের আমদানিনির্ভরতার হার হিসাব করা হয় মোট উৎপাদনের বিপরীতে আমদানির পরিমাণ দিয়ে (মোট আমদানি/মোট দেশীয় উৎপাদন)। ওই অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে আমদানিনির্ভরতার হার ছিল ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ওই সময় দেশে চাল ও গম আমদানি হয়েছিল ৬৪ লাখ ৫৬ হাজার টন। আর মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৩ হাজার টন। সেখান থেকে বেড়ে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) তা ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারি চালের মজুদ হরাস ও বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার কারণে গত অর্থবছরে কয়েক মাসের জন্য বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে শুল্কছাড় সুবিধা দেয়া হয়। ওই সুবাদে দেশে শুধু চালেরই আমদানি দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টনে। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে দেশে মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৬ লাখ ৫৬ হাজার টন। তার বিপরীতে বিবিএস খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদনের তথ্য এখনো চূড়ান্ত করেনি। তবে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ওই সময় দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার টন। তাছাড়া আগের কয়েক বছরের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ীও গত কয়েক বছরে দেশে আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানিনির্ভরতার হার ছিল ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ওই নির্ভরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই বছর দেশে খাদ্যশস্যের আমদানিনির্ভরতার হার ছিল ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওই সময় দেশে প্রায় ১ কোটি টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছিল। তার আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানিনির্ভরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আগের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ওই হার ছিল ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ।
সূত্র আরো জানায়, দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকারিভাবে বেশকিছু উদ্যোগ ও নীতি সহায়তামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের তা বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও জটিলতা রয়েছে। এখন পর্যন্ত ভর্তুকিকেই কৃষি খাতে সরকারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ওই ভর্তুকির অর্থের সিংহভাগই সার বাবদ ব্যয় হচ্ছে। তাছাড়া কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের দেয়া ভর্তুকিগুলোর কার্যকারিতাও সমান নয়। আর ওসব সহায়তার সুবিধাভোগী কৃষক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা তার সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে ওসব কৃষকের পক্ষে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাছাড়া সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। অথচ সারের সুষম ব্যবহার হলো শস্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ মাটির স্বাস্থ্য ভালোভাবে বজায় রাখার মূল চাবিকাঠি।
এদিকে গত কয়েক বছরে দেশে ধানের দাম যে হারে বাড়ছে, উৎপাদন খরচ তার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আর ওই বাড়তি উৎপাদন খরচের পুরোটাই কৃষক বহন করছে। কিন্তু ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে চলে যাচ্ছে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ার সুফল। তাছাড়া বোরো ধান আবাদে কৃষকের মুনাফা এখনো অনেকটা নেতিবাচক পর্যায়েই রয়েছে। তারা ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। পাশাপাশি ভর্তুকির অর্থের বণ্টনও সুষম নয়। ফলে মাঠ পর্যায়ের ক্ষুদ্র ও সাধারণ কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট দেখা দিচ্ছে। তাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাণিজ্যিকের পরিবর্তে খোরপোষের কৃষিতে আটকে যাচ্ছে। ভর্তুকি সুবিধার পরিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচও সঠিকভাবে কমানো যাচ্ছে না। তাতে প্রান্তিক কৃষকরা খাদ্যশস্যের পরিবর্তনে অন্য ফসল উৎপাদনে বেশি ঝুঁকছে। আর সার্বিক খাদ্য উৎপাদনে তার প্রভাব পড়ছে।
এদিকে খাদ্য গবেষকদের মতে, দেশে খাদ্যশস্যের কৌশলগত মজুদের জন্য আমদানি করা যেতে পারে। তবে তা কোনোভাবেই মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি নয়। বেশি আমদানি হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রয়োজন উৎপাদিকা শক্তি। কিন্তু নানান কারণেই তা কমে গেছে। তাছাড়া এদেশে উৎপাদনের উপকরণের ব্যবহারও ভারসাম্যহীন। বিশেষ করে পানি ও ইউরিয়া সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। অথচ সব ধরনের ঝুঁকি এড়াতে দেশেকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ওই লক্ষ্যে আমদানিনির্ভরতা কমাতে ফলন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য শস্য জাতের উন্নয়ন ও মানসম্মত বীজ সরবরাহ বাড়ানো, মাটির স্বাস্থ্য, বালাই ব্যবস্থাপনা ও কৃষিতাত্তি্বক প্রয়োগনীতি, স্থানীয় সেবা প্রদান ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। তাছাড়া বাজার ব্যবস্থা, কৃষি গবেষণা ও যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়ন, বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিরও কোনো বিকল্প নেই। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে ভালো মানের বীজ প্রয়োজন। কিন্তু দেশের মোট বীজ চাহিদার বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ হচ্ছে। আবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহকৃত বীজেও মানহীনতার অভিযোগ রয়েছে। নানান সময়ে ওসব বীজ নিয়ে কৃষক প্রতারিত হচ্ছে। ফলে দেশে মানসম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বীজের চাহিদা যেমন বাড়ছে না, তেমনি মাঠ সম্প্রসারণ পর্যায়ে তা নিশ্চিত করতে আরো কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। আবার হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিশ্বের সিংহভাগ ধান উৎপাদনকারী দেশগুলো হাইব্রিড ও উফশী জাতের ব্যবহার বাড়াচ্ছে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে উঠেছে। শীতের প্রকোপ কমে যাওয়ায় গমের উৎপাদন নিম্নমুখী হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানা দুর্যোগের কারণেও এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বিশেষজ্ঞরা বর্তমানে খাদ্যশস্যের ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে মনোযোগ দিচ্ছে। তারা বলছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত বীজপ্রাপ্তি সুবিধা বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্ধিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। কৃষকদের জন্য মানসম্মত বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় গবেষণা কর্মসূচি, বীজ প্রত্যয়ন সংস্থার সক্ষমতা ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বীজবর্ধন কর্মসূচিকে আরো জোরালো করে তোলা জরুরি।