স্টাফ রিপোর্টার: করোনাজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে বড় ধরনের খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে খাদ্যশস্যের দামে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বিগত পাঁচ দশকে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩ গুণ বেড়েছে। বৈশ্বিক চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। যে কারণে কভিডকালেও বাংলাদেশকে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) গ্লোবাল এগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের (গেইন) প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলাদেশকে আমদানিনির্ভরতায় ফিরতে হবে। চলতি অর্থবছরে শুধু গমই আমদানি করতে হবে প্রায় ৬৬ লাখ টন। সব মিলিয়ে দেশে এবার খাদ্যঘাটতি মেটাতে চাল ও গম আমদানি করতে হতে পারে প্রায় ৭৭ লাখ টন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এবার স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হতে পারে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গেইন-এর তথ্যানুযায়ী চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে চালের উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টন, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন কম। যদিও এ সময় দেশে খাদ্যপণ্যটির চাহিদা থাকবে প্রায় ৩ কোটি ৫৯ লাখ টন। ওই হিসেবে দেশে এবার চালের ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ১১ লাখ টন। আর এ সময়ে দেশে গমের চাহিদা থাকবে প্রায় ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টন। যদিও উৎপাদন হবে মাত্র ১২ লাখ ২০ হাজার টন। সব মিলিয়ে দেশে এবার প্রায় ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) দেশে মোট ৩ কোটি ৮৭ লাখ ২৪ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৯৬ লাখ টন। যদিও ইউএসডিএর প্রক্ষেপণ বলা হয়েছে, এবার চালের উৎপাদন হবে লক্ষ্যের তুলনায় অনেক কম।
সূত্র জানায়, এ যাবৎকালের মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সর্বোচ্চ খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছিল। ওই সময় তার পরিমাণ ছিল ৯৭ লাখ ৭৪ হাজার টন। মূলত চালের আমদানি শুল্ক কমানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওই বছর উৎপাদন কমে গিয়েছিল। ফলে আমদানি বাড়াতে হয়। তবে চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানির নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তরের সংশোধিত চাহিদা অনুযায়ী এবার খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে ২৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭ টন। তার মধ্যে চাল ১৮ লাখ ৬৫ হাজার টন ও গম ৫ লাখ ৯০ হাজার টন। পাশাপাশি খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আনুমানিক প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ঐতিহাসিক সাফল্যের পরও চলতি অর্থবছরে আমদানিনির্ভরতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি বড় কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের আশঙ্কা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব এবার খাদ্যশস্য উৎপাদনে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত ও রোগের প্রাদুর্ভাবে কয়েক বছর ধরেই গমের উৎপাদন নিম্নমুখী। পাশাপাশি দেশে চাল সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস বোরো ধানেও কৃষকের তেমন কোনো মুনাফা নেই। কৃষি সরবরাহ চেইনের নানা জটিলতা এখনো গ্রামের কৃষকের অর্থবিত্ত বৃদ্ধির পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে। যদিও ট্রেডার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা সম্পদ বাড়িয়ে ক্রমেই বিত্তশালী হয়ে উঠছে। তাছাড়া কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণের পথেও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মানসম্মত বীজের প্রাপ্যতা নিয়েও সংকট রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫ শতাংশেই এখনো ধান চাষ হচ্ছে। প্রায় ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। কিন্তু মুনাফার দিক থেকে বোরো আবাদে কৃষকের অর্জন শূন্য। উল্টো প্রতি হেক্টর বোরো আবাদে কৃষকের এখন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। ওই কারণে অনেক কৃষকই বোরো আবাদে নিরুৎসাহিত হয়েছে। যা সার্বিক উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
এদিকে পরিসংখ্যানের গরমিল কৃষি খাতের বড় একটি দুর্বলতা। সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি খোদ কৃষিমন্ত্রী নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানেও এ অভিযোগের যথার্থতা পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৬ সালের মাথাপিছু দৈনিক চালভোগের পরিমাণ নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)। ওই জরিপে উঠে আসে ওই বছর দেশে দৈনিক মাথাপিছু চাল ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২৬ গ্রাম। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপের হিসাব মতে, ওই বছর দেশের জনগণের দৈনিক মাথাপিছু চাল ভোগের পরিমাণ ছিল ৩৬৭ গ্রাম। কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সামগ্রিক তথ্যের সঠিকতা নিয়ে কৃষিমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, বিভিন্ন খাদ্যপণ্য বছরে কতটুকু উৎপাদিত হচ্ছে, চাহিদা কতটুকু বা উৎপাদন বছরে কতটুকু বাড়ছে এসবের প্রকৃত ও সঠিক তথ্য দরকার। কিন্তু সেটি যৌক্তিকভাবেই করা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে আলু ও ধান-চালের দাম বৃদ্ধি এ বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। তার মতে, দেশে ওসব কৃষিপণ্যের আবাদ, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার (এশরপ্রতি) যে পরিসংখ্যান রয়েছে, তা সঠিক নয়। তবে দেশে খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটাতে হলে আমদানিনির্ভরতা কোনো টেকসই সমাধান নয়। কারণ অর্থ থাকলেও বৈদেশিক বাজার থেকে খাবার পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। সেজন্য কৃষিমন্ত্রী কৃষিসংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে বিশেষ নজর বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন।
অন্যদিকে এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জানান, কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি মানেই ঘাটতির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলে সুন্দর পরিকল্পনাও বাস্তবায়নে গলদ দেখা দিতে পারে। জনপ্রতি চালের যে ভোগ দেখানো হচ্ছে, তাতে উৎপাদনের তথ্যের সঙ্গে বড় ধরনের চাল উদ্বৃত্তের তথ্যও থাকতে হবে। কিন্তু বাজার তথ্য সেটি বলছে না। ফলে উৎপাদন বা ভোগের তথ্যে গরমিল রয়েছে। বাজার তথ্যের সঙ্গে প্রকাশিত সব তথ্যের একপর্যায়ে মিল থাকা প্রয়োজন। তা না হলে নীতি প্রণয়নে বিশেষ করে চাল আমদানি কিংবা রফতানির বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। তথ্যের বিষয়ে বিবিএসের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হতে হবে। প্রয়োজনে আরো সঠিকতার জন্য বৈজ্ঞানিক বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগের উদ্যোগও বিবিএসকেই নিতে হবে।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, খাদ্যশস্যের উৎপাদনে গতি ধরে রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সময়ে সঠিক পরিমাণে খাদ্যশস্য আমদানির মাধ্যমে মানুষের চাহিদা পূরণে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে মহামারী পরিস্থিতিতে দেশের কোথাও খাদ্য সরবরাহে সংকট তৈরি হয়নি। আবার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্যের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ ছিল। ওই কারণে দেশের খাদ্য সরবরাহ বেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরে খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়ানোর সব ধরনের উদ্যোগ চলমান রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আমদানি উভয় বাজার থেকে সংগ্রহ প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে আমদানিকৃত চাল ও গম আসতে শুরু করেছে। প্রায় ৬ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে আগামী জুন পর্যন্ত খাদ্যশস্যের মজুদ নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই উৎপাদনে যদি কিছুটা কমতিও থাকে সরবরাহে কোনো ধরনের ঘাটতি বা সংকট তৈরি হবে না।
একই বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্য হচ্ছে, প্রতি বছরই দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে। করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই বাংলাদেশ চালের উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। সুতরাং মহামারীর মধ্যে খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। যা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে পরিসংখ্যানগত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও খাদ্য উৎপাদনে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হবে না। চলতি অর্থবছরে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে ইতোমধ্যে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধিসহ উন্নত বীজের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করতে মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।