kbdnews ডেস্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী দৌড়ে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে চাওয়া মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যেতে রাজি নন। কয়েকটি রাজ্যে ডেমোক্র্যাট শিবিরের বিরুদ্ধে ভোট চুরির অভিযোগ এনে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। তবে তার এই হুমকির পর মার্কিন আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নির্বাচনে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত মীমাংসাকারী নাও হতে পারে। তারা বলেছেন, নির্বাচনের দিন অথবা তার আগে প্রাপ্ত ব্যালটের গণনা বন্ধ করার জন্য ট্রাম্পের আবেদন অথবা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার গতিপথ বদলে দিতে সক্ষম মিশিগান এবং পেনসিলভানিয়ার মতো তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ রাজ্যগুলোর বিরোধ আদালত নিষ্পত্তি করবেন, এটা সন্দেহজনক।
স্থানীয় সময় গত বুধবার সকাল পর্যন্ত অনেক রাজ্যে ভোট গণনা অব্যাহত রয়েছে। এর মাঝেই ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে হাজির হয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে মিথ্যা জয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন এখন পর্যন্ত ২৬৪ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন, বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঝুলিতে জমা পড়েছে ২১৪টি। ফল ঘোষণা হয়নি নেভাদা (৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট), পেনসিলভানিয়া (২০টি), নর্থ ক্যারোলাইনা (১৫টি), জর্জিয়ায় (১৬টি) এবং আলাস্কায় (৩টি)। এই ৫টি রাজ্যের ৪টিতে ট্রাম্প এগিয়ে থাকলেও নেভাদায় বাইডেনের জয়ের সম্ভাবনা প্রবল।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট ডাকযোগের ভোটের বিরুদ্ধে নিজের সুর চড়িয়েছেন। কোনো ধরনের প্রমাণ দেখাতে না পারলেও এতে জালিয়াতি হতে পারে বলে দাবি করেছেন তিনি, যা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল। ডাকযোগের ভোটের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, এটা মার্কিনিদের জন্য বিশাল জালিয়াতি। আমরা আইনের সঠিক ব্যবহার চাই। সুতরাং আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাবো। আমরা সব ধরনের ভোটগ্রহণ বন্ধ চাই। সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিলেও নিজের দাবির পক্ষে প্রমাণ কিংবা বিস্তারিত তথ্য তিনি কখনই প্রকাশ করেননি। তার ঘোষণার পর পেনসিলভানিয়া রাজ্যে দেরিতে পৌঁছানো ডাকযোগের ভোট গণনা ঠেকাতে রিপাবলিকান শিবির সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে মামলা করেছে। পেনসিলভানিয়া রিপাবলিকান শিবিরের এই মামলা এখনো ঝুলে রয়েছে।
মিশিগানে ভোট গণনা বন্ধসহ ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা শিবির ও রিপাবলিকানরা অন্য কয়েকটি রাজ্যেও অভিযোগ দায়ের করেছে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কয়েকটি রাজ্যে আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফল আসতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত মার্কিন নির্বাচন ভারসাম্যহীন অবস্থায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্দিষ্ট ব্যালট কিংবা ভোটদান এবং গণনার প্রক্রিয়ার বিষয়ে আপত্তি থাকতে পারে। তবে এ ধরনের বিরোধ চূড়ান্ত ফল নির্ধারণ করবে কিনা সেটি স্পষ্ট নয়। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞ নেড ফোলে বলেন, এবারের নির্বাচনে এমন কোনো উপাদান নেই, যা ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ওই বছর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী আল গোরের প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান জর্জ বুশকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্ট। ফোলে বলেন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলাটা আগাম হয়ে যাবে। তবে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কি ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন তা আপাতদৃষ্টিতে এবং এই মুহূর্তে ধারণা করা যাচ্ছে না।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই নির্বাচন আদালত পর্যন্ত গড়ালে উভয় পক্ষই তা মোকাবিলায় আইনজীবীদের প্রস্তুত করে রেখেছে। বাইডেন শিবির ইতোমধ্যে দেশটির আইনিসংস্থা পার্কিনস কোয়ের শীর্ষ নির্বাচনী অ্যাটর্নি মার্ক এলিয়াস, সাবেক সলিসাইটর জেনারেল ডোনাল্ড ভারিলি ও ওয়াল্টার ডেলিঞ্জারকে নিয়োগ দিয়েছে। অন্যদিকে, ট্রাম্পের আইনজীবী দলে রয়েছেন তার নির্বাচনী প্রচারণা শিবিরের সাধারণ পরামর্শক পরিষদের সভাপতি ম্যাট মর্গান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী উইলিয়াম কনসোভয় ও প্রচারণা শিবিরের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জাস্টিন ক্লার্ক।
তবে ভোট গণনার সময় মিশিগানের বেশ কয়েকটি কাউন্টিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর নির্বাচনী কর্মীদের উপস্থিতি এবং অধিকার প্রয়োগে বাধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে ১৬ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট থাকা মিশিগানে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে উইসকনসিনের মতো এ অঙ্গরাজ্যেও চমক দেখাতে চলেছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। আর তাই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসা এখনো বাকি থাকলেও আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ট্রাম্পের নির্বাচনী দল। রাজ্যটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯৬ শতাংশ ভোট গণনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট নিয়ে এগিয়ে আছেন বাইডেন। আর ট্রাম্পের দখলে আছে ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ ভোট।
ট্রাম্পের নির্বাচনী দলের ম্যানেজার বিল স্টিপেইনের অভিযোগ, মিশিগান রাজ্যের বেশ কয়েকটি কাউন্টির ভোট গণনার সময় ট্রাম্প শিবিরের কর্মীদের উপস্থিত হতে দেয়া হয়নি। একই সঙ্গে আইনগত বেশ কয়েকটি অধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এজন্য অঙ্গরাজ্যটির মিশিগান ক্লেইম কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিল স্টিপেইন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, মিশিগানে যেহেতু ভোট গণনা চলছে রাজ্যটিতে প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতা খুবই শক্ত হচ্ছে। যেমনটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। মিশিগান আইন অনুযায়ী নির্ধারিত থাকার পরেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী কর্মীদের বিভিন্ন কাউন্টির ব্যালট উন্মুক্ত করা এবং গণনার সময় যথাযথ অনুপ্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এজন্য আমরা আমাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পরবর্তী ভোট গণনা স্থগিত রাখার আবেদন করে মিশিগান ক্লেইম কোর্টে মামলা দায়ের করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের প্রবেশ ব্যতীত যেসব ভোট গণনা করা হয়েছে সেগুলো পুনরায় যাচাই করার জন্য আমরা আবেদন করেছি। মিশিগানসহ অন্য সব জায়গায় বৈধ ভোট গণনা নিশ্চিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বদ্ধপরিকর।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জালিয়াতির চেষ্টার যে অভিযোগ করেছেন, সেটি আদালতে তোলার যৌক্তিকতা আছে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রাম্পের অ্যাটর্নি জেনা এলিস। ফক্স নিউজকে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমাদের যদি এই আইনি চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়, তাহলে সেটি নজিরবিহীন কোনো ঘটনা নয়। ফক্স বিজনেস নেটওয়ার্ককে এলিস বলেন, তিনি এটা নিশ্চিত করতে চান যে, নির্বাচন চুরি হয়নি। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে এসেও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কে হচ্ছেন নতুন প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনে রণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে যখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের টানটান উত্তেজনা চলছে ঠিক তখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিক্ষোভ। পোর্টল্যান্ড, ওরেগনে প্রতিটি ভোট গণনার দাবিতে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠলে ন্যাশনাল গার্ড সক্রিয় হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বিক্ষোভ থেকে কিছু মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে সিটি সেন্টারের কিছু দোকানের জানালা ভাঙচুর করেছে। এক দাঙ্গা বলে উল্লেখ করেছে দেশটির পুলিশ। মিনিয়াপোলিসে দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী রাস্তা দখল করলে সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। মার্কিন গণমাধ্যমগুলো বলছে, বিক্ষোভকারীরা ডেনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ভোট বন্ধের আহ্বানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন। একই ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে নিউইয়ার্ক, ফিলাডেলফিয়া ও শিকাগোতে। ডেট্রয়েটে ট্রাম্প সমর্থকরা ভোট গণনা কেন্দ্রের বাইরে জড়ো হয়ে ভোটগণনা বন্ধ করো বলে সেস্নাগান দিতে থাকে। সে সময় জানালা ভাঙচুর করে তারা। অ্যারিজোনা ও ফিনিক্সেও একই ঘটনায় ছোটখাটো বিক্ষোভ হয়। এরই মধ্যে ৪৫টি অঙ্গরাজ্যের ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি আছে ৫টির ফলাফল। এগুলো হলো-নেভাদা, আলাস্কা, পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলিনা। এই ৫টি অঙ্গরাজ্যের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে, কে হচ্ছেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট। এর মধ্যে নেভাদায় ৬টি, আলাস্কায় ৩টি, জর্জিয়ায় ১৬টি, নর্থ ক্যারোলিনায় ১৫টি ও পেনসিলভানিয়ায় ২০টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে। আপাতত সব হিসাবেই বাইডেন এগিয়ে থাকলেও ওই ৫ রাজ্যের সবকটিতে যদি ট্রাম্পের জয় হয় তবে বাইডেন শিবিরের বিজয়ী হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ ট্রাম্পের দরকার আরো ৫৬টি ইলেকটোরাল ভোট। ওই ৫টি অঙ্গরাজ্যে মোট ইলেকটোরাল ভোট আছে ৬০টি। সবগুলো যদি ট্রাম্প পেয়ে যান তবে তার মোট ইলেকটোরাল ভোট হবে ২৭৪টি। আর তখন বাইডেনের চেয়ে ১০টি ইলেকটোরাল ভোট বেশি হয়ে যাবে ট্রাম্পের।
সবশেষ নির্বাচনী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পও পিছিয়ে থাকলেও ওই ৫ রাজ্যের দিকে তাকিয়ে এখনো আশা ছাড়েননি। ৫ রাজ্যের মধ্যে ৪টিতেই এগিয়ে আছেন তিনি। এর মধ্যে শুধু নেভাদায় এগিয়ে বাইডেন। নেভাদা যদি ডেমোক্র্যাটদের দখলে চলে যায় তবে ট্রাম্পের আশার প্রদীপ নিশ্চিত নিভে যাবে। সেক্ষেত্রে বাইডেন ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যাবেন। বাইডেন নেভাদায় জয়ী হলে আর ট্রাম্প বাকি ৪টি অঙ্গরাজ্যে জয়ী হতে পারলে মাত্র ২টি ইলেকটোরাল ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হয়ে যাবেন বাইডেন।