বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভারত এ দেশ থেকে অনেক সুবিধা পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের প্রতি তাদের গভীর বন্ধুত্বের প্রতিফলন ঘটেনি। বিভিন্ন সময়ে ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সীমান্ত বৈঠকগুলোয় ‘সীমান্ত হত্যা’ শূন্যে নামিয়ে আনার একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো সেটির বাস্তবায়ন হয়নি। তাছাড়া তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্তে মাদকসহ অন্যান্য চোরাচালান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে না থাকা, বাণিজ্য খাতে হঠাৎ করেই পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের পরিবর্তনসহ বাংলাদেশকে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট না দেয়ায় বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব শিথিল না হলেও তা অনেকটাই ‘একপেশে’ সম্পর্কের মতো হয়ে পড়ছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করছেন না অনেকেই। এছাড়া বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি জোরদারে অস্বস্তিতে ভারত। এ অস্বস্তির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ মনে করা হচ্ছে তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগকে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে আরো উষ্ণ করে তোলার চেষ্টায় উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এমনই এক প্রেক্ষাপটে আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ষষ্ঠ জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক।
কিছুদিন আগেও কূটনীতিকরা বলছিলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। দুই দেশের সরকার প্রধানও এ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আখ্যায়িত করেছেন সোনালি অধ্যায় হিসেবে। তবে সমপ্রতি বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতীয় গণমাধ্যম
দাবি করছে, বাংলাদেশ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে দেশটি। দ্য ইকোনমিস্টেও সমপ্রতি দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘অ্যাজ বাংলাদেশ’স রিলেশনস উইথ ইন্ডিয়া উইকেন, টাইজ উইথ চায়না স্ট্রেংদেন (বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যত দুর্বল হচ্ছে, ততটাই জোরালো হচ্ছে চীনের সঙ্গে)। এ প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রধান রাহুল গান্ধী এক টুইট বার্তায় বলেন, কংগ্রেস দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার যে সম্পর্ক তৈরি ও লালন করেছে, নরেন্দ্র মোদী তা ধ্বংস করে দিয়েছেন।
তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের সচকিত হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটেই গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশে এক ঝটিকা সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ওই সফরের মধ্য দিয়েই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের সূচি নির্ধারিত হয়। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে এয়ার বাবল চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া এবারের বৈঠকে তিস্তা চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশকে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়া, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়াসহ বাংলাদেশকে দেয়া ভারতীয় ঋণ চুক্তি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। আর ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
আসন্ন জেসিসি বৈঠক নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা বৈঠকে কী নিয়ে আলাপ করব, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ করছি। আমাদের কী পজিশন হবে, এসব নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এখনো কোনো কিছু চূড়ান্ত করা হয়নি।
এর আগে দিলি্লতে ২০১৯ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পঞ্চম জেসিসি বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। ফলে এবারের বৈঠকটি ঢাকায় হওয়ার কথা ছিল। এ অনুযায়ী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের কথা থাকলেও চলমান কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে জেসিসি বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভার্চুয়ালি। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ২৯ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) জেসিসি বৈঠক আয়োজনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
অন্যদিকে বৈঠক নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক জনতাকে বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরেই ঠিক করা হয়েছিল সেপ্টেম্বরের শেষে দুই দেশের মধ্যকার জেসিসি বৈঠক আয়োজন করা হবে। বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তবে আলোচ্যসূচি এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে, চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, এবারের বৈঠকে এয়ার বাবল চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির অগ্রগতি নিয়েও জানতে চাওয়া হবে। এবারের বৈঠকে তিস্তা নিয়ে কিছু সুখবর পাওয়ার আশায় রয়েছে বাংলাদেশ।
সূত্র মতে, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা, সীমান্তে মাদকসহ অন্যান্য চোরাচালান, বাংলাদেশকে টার্গেট করে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, আসামের এনআরসি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে না থাকা, বাণিজ্য খাতে হঠাৎ করেই পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের পরিবর্তনসহ বেশকিছু বিষয়ে বাংলাদেশের অস্বস্তি রয়েছে। এছাড়া তিস্তায় বিনিয়োগের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি জোরদার হয়ে ওঠায় বিষয়টি ভারতেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিভিন্ন সময়ে ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সীমান্ত বৈঠকগুলোয় ‘সীমান্ত হত্যা’ শূন্যে নামিয়ে আনার একাধিক প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো সেটির বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি করোনাকালেও সীমান্তে ৩৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় এসব বৈঠকের কার্যকারিতা কী বলে প্রশ্ন উত্থাপন করেন তিনি। একই সঙ্গে সামপ্রতিক পেঁয়াজ ইস্যু সামনে নিয়ে এসে তিনি বলেন, ভারতের পক্ষ থেকে প্রায়ই ছোট বিষয় নিয়ে বৈরিতা তৈরি করা হয়, যা এক ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার ঋণ চুক্তি বা এলওসি নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে। আর বাংলাদেশ যেহেতু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য পদে ভারতের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, সেহেতু বাংলাদেশও চাইবে ভারত এবার নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে সোচ্চার থাকুক। এছাড়া দুই দেশের ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়েও আলোচনা হবে। ভারত এরই মধ্যে এ চুক্তি ব্যবহার করে পণ্য পরিবহণও করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহণের জন্য ভারতের কাছ থেকে এ সুবিধা পায়নি। ফলে এবারের বৈঠকে এ বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হবে।