অবশেষে দেশে ঢুকতে শুরু করেছে বিভিন্ন স্থলবন্দরে আটকে থাকা ভারতের পেঁয়াজভর্তি ট্রাক। ভারত সরকারের অনুমতির প্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ শুরু করে পেঁয়াজবাহী ট্রাক। তবে কয়েকদিনের গরমে আটকে থাকা পেঁয়াজের বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।
শনিবার বেলা ১১টার সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে প্রথম ট্রাকটি ঢোকে। আর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজের ট্রাক আসতে শুরু করে। এ সময় বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় দেখা যায় দুইশ শতাধিক ট্রাক।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। এতে করে দেশের স্থলবন্দরগুলোর ওপারে আটকে পড়ে শত শত পেঁয়াজবাহী ট্রাক। তবে তার একদিন পরই আগের এলসি করা পেঁয়াজ রফতানির অনুমতি দেয় দেশটি। গত শক্রবার রাতে আটকে থাকা পেঁয়াজ রফতানিতে বন্দর ও কাস্টমসহ বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠায় ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরই প্রেক্ষিতে শনিবার সকালে প্রথম ট্রাক প্রবেশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে। সোনা মসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে দুপুর পর্যন্ত ঢুকেছে ৭টি পেঁয়াজবাহী ট্রাক। প্রবেশের অপেক্ষায় আছে আরো আড়াইশ ট্রাক।
পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা তোলার দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকেই শুরু হয়ে যায় মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষিদের আন্দোলন। নাসিকের কাছে লাসালগাঁও মান্ডির সামনে তারা শুরু করে দেন অবস্থান বিক্ষোভ। রাজ্যের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও এনসিপি দলের নেতা শারদ পাওয়ার কৃষকদের দাবিকে সমর্থন জানান। তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়ে আমরা পাকিস্তানের সুবিধা করে দিচ্ছি না তো?’
সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ঢাকার দিক থেকেও প্রয়োগ করা হতে থাকে কূটনৈতিক চাপ। দিলি্লতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনৈতিক তৎপরতা তো প্রথম থেকেই চলছিল। এর পর গত বুধবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে একটি ‘কূটনৈতিক নোট’ পাঠিয়ে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।
এই সম্মিলিত চাপের মুখে ভারতকে যে একটা কিছু করতেই হবে, অন্তত বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা ছাড় দিতে হবে,
সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এই পটভূমিতে রফতানি নিয়ে জট খুলতেই গত শুক্রবার দিলি্লর উদ্যোগ ভবনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সদর দফতরে ডিজিএফটি-র শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকরা।
শুক্রবার দিনভর সেই বৈঠকে আলোচনা হয় ভারতের ‘ফেস সেভিং’ বা কূটনৈতিক মুখরক্ষা এখন কীভাবে হতে পারে, মূলত সেটা নিয়েই। তিন-চারদিনের মাথায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়াটা সম্ভব নয়, এটা বোঝাই যাচ্ছিল। নেপাল-শ্রীলঙ্কাকে বাইরে রেখে শুধু বাংলাদেশের জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা করাও ছিল অসুবিধাজনক। এই পরিস্থিতিতে পরিত্রাণের পথ দেখায় বৈদেশিক বাণিজের ক্ষেত্রে ভারতের ‘হ্যান্ডবুক অব প্রসিডিওরস’ (পদ্ধতি-সংক্রান্ত পুস্তিকা)।
ওই হ্যান্ডবুকের অনুচ্ছেদ ৯.১২ (বি)-তে লেখা আছে, ‘যদি বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতিমালা রফতানিকারকদের প্রতিকূলে সংশোধন করা হয়, তাহলে ওই তারিখের ভেতর যেসব চালান ইতোমধ্যেই শুল্ক বিভাগের কাছে পরিদর্শনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে তার ওপর সেই সংশোধিত নীতিমালা প্রযোজ্য হবে না।’
সোজা কথায় বললে, হিলি বা বেনাপোল বন্দরে পেঁয়াজের যেসব ট্রাক ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কাস্টমসের ইন্সপেকশনের জন্য দেয়া হয়েছে, সেগুলো এই নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় পাবে। ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স ও কাস্টমস (সিবিআইসি) ১৫ সেপ্টেম্বর ডিজিএফটি-কে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এরকম বেশ কিছু পেঁয়াজবাহী ট্রাক তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় আছে। যদিও সেই সব চালানের মোট পরিমাণটা এখনো স্পষ্ট নয়।
বৈঠকের পর শুক্রবার বিকাল ৫টা নাগাদ ভারতের সহকারী ডিজিএফটি (রফতানি) নীতিশ সুরি সংশ্লিষ্ট সব মহলে তার সহকর্মী গগনদীপ সিং-কে একটি ইমেইল পাঠিয়ে এই বিষয়টি ‘ক্ল্যারিফাই’ করে দেন। হ্যান্ডবুকের ৯.১২ (বি) অনুচ্ছেদ হুবহু উদ্ধৃত করে তিনি ওই ইমেইলে যা লেখেন, তার অর্থ দাঁড়ায় আপাতত বেশ কিছু পেঁয়াজের চালান ভারত থেকে বাংলাদেশে যেতে পারবে।
শুক্রবার বেশি রাতে দিলি্লতে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি উচ্চপদস্থ সূত্র বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ক্ষেত্রে যে ক্ল্যারিফিকেশন বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে সেটা অত্যন্ত টেকনিক্যাল, কোনো সন্দেহ নেই। তারপরেও আমরা যেটা বুঝতে পারছি, রফতানির জন্য যে পেঁয়াজগুলো পাইপলাইনে আছে সেটা অন্তত বাংলাদেশে যেতে পারবে।’
ফলে এখনকার মতো দিলি্লতে সাময়িকভাবে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান, পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমায় হাঁফ ছেড়েছে বাংলাদেশের আমজনতাও।
তবে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে নিতে ভারত সরকারের আরো উঁচু পর্যায়ে বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আভাস মিলেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের মধ্যেও অচিরেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে এবং গত বছরের মতো বেশ কয়েক মাস নয়, এই নিষেধাজ্ঞা সম্ভবত কয়েক দিন বা বড়জোর কয়েক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হবে না।
গতকাল সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার সাইফুর রহমান জানান, দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাতটি ট্রাকে ১৯৯ টন পেঁয়াজ দেশে ঢুকেছে। এখনো ভারতের বন্দরে তিনশ’র বেশি ট্রাক আটকে আছে বলে জানান আগত ট্রাক চালকরা। কয়েকদিন ট্রাকের পেঁয়াজ আটকে থাকায় গরমে নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন পাইকাররা।
সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম জানান, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে দুপুর একটা থেকে শুরু হয় পেঁয়াজবাহী ট্রাকের প্রবেশ। ২৫ ট্রাকে মোট ৬২৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ এসেছে। তবে এসব পেঁয়াজের অর্ধেকই পচে গেছে।
এদিকে বেনাপোল ও হিলি স্থলবন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে কয়েকশ পেঁয়াজবাহী ট্রাক। বন্দরগুলো দিয়ে পেঁয়াজ ঢোকার সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে বলে জানান আমদানিকারকরা।
এদিকে মায়ানমার থেকে আবারো পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। প্রায় আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর গত শুক্রবার ও গতকাল শনিবার দুই দিনে ৪৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ এসে পৌঁছেছে টেকনাফ স্থলবন্দরে। টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, জুন মাসের শেষ দিকে মংডু-আকিয়াব বন্দরে করোনারোগী শনাক্ত হওয়ায় মায়ানমার থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় প্রায় আড়াই মাস পর শুক্রবার দুইটি জাহাজে করে প্রায় ৩০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসে। গতকাল শনিবার আরো একটি জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে, সেখানেও আনুমানিক ১৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ হবে।
জসীম উদ্দীন আরো জানান, শুক্রবার ও শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় আমদানি করা পেঁয়াজের কাগজপত্র এখনো জমা হয়নি। তবে, যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে খালাসের পর পেঁয়াজ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হবে।
ভারতের পেঁয়াজ আসা বন্ধের পর দেশের আমদানিকারকরা এ পর্যন্ত ছয়টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন বা আইপি নিয়েছেন। দেশগুলো হলো চীন, তুরস্ক, মিসর, নেদারল্যান্ডস, মায়ানমার ও পাকিস্তান। এর মধ্যে চীন থেকে আসতে সময় লাগবে ১৪ দিন; তুরস্ক, মিসর ও পাকিস্তান থেকে আসতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ১৭ দিন। নেদারল্যান্ডস থেকে আসতে লাগবে ১৮ দিন।
জানা গেছে, উচ্চপর্যায়ে বৈঠকের পর মায়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। এসব পেঁয়াজ যত দ্রুত সম্ভব খালাস করে বাজারে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
টেকনাফ শুল্ক বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মায়ানমার থেকে গত নভেম্বরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২১ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন। এছাড়া অক্টোবর মাসে ২০ হাজার ৮৪৩ মেট্রিক টন, আগস্ট মাসে ৮৪ মেট্রিক টন এবং সর্বশেষ জুলাই মাসে এসেছিল ৮৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ। দেশে চলমান পেঁয়াজ সংকটে আবারও এগিয়ে এসেছে অন্যতম শিল্প গ্রুপ এস আলম। নেদারল্যান্ড, তুরস্ক, মিসরসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করবে তারা। এক মাসের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এসব পেঁয়াজ বাজারে ঢুকবে বলে জানিয়েছেন এস আলম গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার কাজী সালাহউদ্দিন আহম্মদ।
তিনি বলেন, সংকট মোকাবিলায় সরকার ও দেশের চাহিদা মোতাবেক আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে এক লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে চাই। আজ (রোববার) ২০ হাজার টনের এলসি খোলা হবে ব্যাংকে। আমাদের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সকল নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে বলেছেন। প্রয়োজনে কার্গো বিমানে করে দ্রুত পেঁয়াজ এনে দেশের বাজার সামাল দিতেও আগ্রহী আমরা। তবে এক্ষেত্রে বিমানভাড়া জাহাজের চেয়ে অন্তত ছয়গুণ বেশি। তাও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ভারত থেকে সমপ্রতি পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশের বাজারে তীব্র সংকট দেখা দেয়। তিন দিনের ব্যবধানেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় দুই থেকে তিনগুণ।
গতকাল শনিবার সকালে চট্টগ্রামের বাজার থেকে ওবায়দুল হক পেঁয়াজ কিনেছেন কেজি ৭০ টাকা করে। তিনি বলেন, ‘দাম বেশি হওয়ায় এক কেজির পরিবর্তে আধা কেজি পেঁয়াজ কিনেছি।’
বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে আমদানির অধিকাংশ পেঁয়াজই আসে ভারত থেকে। দেশের হিলি, বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরাসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে এসব পেঁয়াজ দেশে আসত। দেশে বর্তমানে প্রতি বছর চাহিদা হলো আনুমানিক ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। বাকি পেঁয়াজের সিংহভাগ আমদানি করা হত ভারত থেকে। সামান্য কিছু পেঁয়াজ আসত মায়ানমার ও চীন থেকে।
কার্গো বিমানে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসার বিষয়ে জানা গেছে, নেদারল্যান্ড, তুরস্ক ও চীন থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে করে পেঁয়াজ আনতে মূল সমস্যা হলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কন্টেইনার (রিফার) অর্থাৎ কোল্ড স্টোরেজের (যার তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি পর্যন্ত) বুকিং পাওয়া। এ ধরনের বিশেষ কন্টেইনারে সর্বোচ্চ ২৫ টন ধারণক্ষমতা। আর এ ধরনের কন্টেইনার না পেলে পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম শিপিং প্রতিষ্ঠান কন্টিনেন্টাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনার পরিচালক আহসান ইকবাল চৌধুরী আবীর বলেন, ‘রিফার কন্টেইনারে করে এত বিপুল পরিমাণ পণ্য এক সঙ্গে আনা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একইসঙ্গে এর ভাড়াও তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এভাবে দ্রুত পেঁয়াজ আনা সম্ভব।’