কক্সবাজার থেকে কফিল উদ্দিন আনু : টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস নির্দেশ দিয়েছিলেন! ওসির নির্দেশ পেয়ে শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) এসআই লিয়াকত গুলি করেন মেজর সিনহাকে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে অধীনস্থ ওসি, আইসিকে রক্ষা করতে সাফাই গাইলেন কঙ্বাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন, ভিডিও, ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী, পুলিশের টেলিফোন রেকর্ড অনুযায়ী ফেঁসে যাচ্ছেন কঙ্বাজারের এসপি, টেকনাফ থানার ওসি ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের আইসি।
মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকা-ের প্রেক্ষাপটে ৭টি মন্তব্য ও ৫টি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কঙ্বাজার জেলায় বিশেষ করে টেকনাফ থানায় মাদক নির্মূলের নামে পুলিশ সদস্যদের মাঝে হত্যার প্রতিযোগিতা চলমান। যা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো দিবে বলে ধারণা করা যায়।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির দেয়া উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত কঙ্বাজার জোলায় ২১৮টি বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ঘটেছে ১৪৪টি ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা, যেখানে মারা গেছেন ২০৪ জন।
সামরিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেদিন টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে কঙ্বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬)। সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন সিফাত নামের আরেকজন। মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি প্রথমে বিজিবির একটি চেকপোস্টে এসে থামে। পরিচয় পাওয়ার পর বিজিবি সদস্যরা তাদের ছেড়ে দেন। এরপর রাত ৯টার দিকে সিনহার গাড়িটি এসে পৌঁছায় দ্বিতীয় চেকপোস্ট টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে।
পুলিশের নির্দেশনা পেয়ে গাড়ি থেকে প্রথমে হাত উঁচু করে নামেন সিফাত। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামলেন মেজর (অব.) সিনহা। কোনোরূপ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মেজর (অব.) সিনহার বুকে একে একে তিনটি গুলি ছোড়েন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। মুহূর্তেই তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। সিনহার ব্যক্তিগত পিস্তল থাকলেও সেটি গাড়িতে ছিল।
নিহত মেজর (অব.) সিনহার গাড়ি থেকে পুলিশ ইয়াবা, মদ ও গাঁজা উদ্ধার করার দাবি করা হলেও তা সত্য নয় বলে উল্লেখ করা হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। ঘটনার পর পুলিশ কঙ্বাজারের নীলিমা রিসোর্টে এসে তল্লাশি করে। সেখানে অবস্থানরত অপর দুইজনের কেবিনে দেশি-বিদেশি মদ ও গাঁজা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, প্রত্যক্ষ সাক্ষী নির্মূল করার প্রয়াসে পুলিশ সে সময় আটককৃত সিফাতকে অস্ত্র/মাদক উদ্ধার অভিযানের নামে হত্যা করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকা- নিয়ে পুলিশের দেয়া বক্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই বরং উল্টো। ৩১ জুলাই (শুক্রবার) রাত সাড়ে ১০টার দিকে হত্যাকা-ের খবর পেয়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একজন মাঠকর্মী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তখন সিনহা মো. রাশেদ খান জীবিত ছিলেন এবং নড়াচড়া করছিলেন। এ সময় ভিডিও করতে গেলে পুলিশ তার মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেন এবং আটক করে রাখেন। রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে একটি মিনি ট্রাক আনা হয়। আনুমানিক রাত ১১টার দিকে মেজর (অব.) সিনহাকে নিয়ে মিনি ট্রাকটি কঙ্বাজার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর হাসপাতালে পৌঁছে ট্রাকটি। ট্রাক ড্রাইভার বলেছেন ওই সময়ে মেজর সিনহার প্রাণ ছিল। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়! সিনহার শরীরের ওপরের অংশ কর্দমাক্ত এবং বুক ও গলা গুলিবিদ্ধ ছিল। পরনে সামরিক পোশাক হাতে হাতকড়া লাগানোর দাগ ছিল। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
এদিকে ওই ঘটনায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাস আগেই খবর পেয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যের পোশাক পরা এক ব্যক্তিসহ দুজন মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কঙ্বাজারের দিকে যাচ্ছেন। তার নির্দেশেই শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশির কাজ শুরু হয়। মৃত্যুর আগে একাধিকবার রাশেদ তার পরিচয় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও দিয়েছিলেন।
ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলীর পিস্তল থেকে চার রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ আছে এজাহারে। সিনহার মৃত্যুর দায় চাপানো হয়েছে তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতের ওপর। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ভাষ্যানুযায়ী এজাহারটি লেখা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় সিফাতের অপরাধ পরস্পর (সিনহা ও সিফাত) যোগসাজশে সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র দিয়ে গুলি তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো। মামলায় বলা হয়, ফাঁড়ির ইনচার্জ এ সময় গাড়িচালকের আসনে বসা ব্যক্তিকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে ধরে দাঁড়াতে বলেন ও বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। কিছুক্ষণ তর্ক করার পর সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেয়া ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হন।
মামলাটি রেকর্ড করেন এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিত। তিনি বলেন, ‘আইসি (ইনচার্জ) স্যার (লিয়াকত আলী) নিজের ও সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা পিস্তল দিয়ে চার রাউন্ড গুলি করেন।’ কঙ্বাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের সুরে সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেন। এই সময়ে তল্লাশি চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তার পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করেন। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।