পটিয়া (চট্টগ্রাম) থেকে সেলিম চৌধুরী : বাণিজ্যিক ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করে নির্ধারিত সময়ের আগে ভাঙিয়ে নেয়ার অজুহাতে ১৫ কোটি টাকা গচ্চা দেয়া নিয়ে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড-এ তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত মার্চে এফডিআরগুলো ভাঙানো হলেও কয়েকদিন আগে বিষয়টি আলোচনায় আসলে যমুনা অয়েলের পাশাপাশি বিপিসিতেও (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) তোলপাড় শুরু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত সময়ের আগে এফডিআর ভাঙানোতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে যমুনা অয়েল আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয়েছেন কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারি। তাছাড়া নগরীর ২০ কিলোমিটার বাইরে গ্রামের ব্যাংকেও এফডিআর করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন গুটিকয়েক কর্মকর্তা। ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি টাকায় সরকারি ব্যাংক বাদ দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
ভাঙানো ৮টি এফডিআর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জুন মাসের কয়েক তারিখে চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পৃথক ৮টি শাখায় সর্বমোট ২১০ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার টাকার এফডিআর করে যমুনা অয়েল কোম্পানি। মূলত বিপিসির পাওনা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করে ওই টাকা ব্যাংকে এফডিআর করার মাধ্যমে অঙ্গ প্রতিষ্ঠানটি লাভবান হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যমুনা অয়েলের কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এদিকে ২১০ কোটি টাকার মধ্যে শুধুমাত্র একটি সরকারি অংশীদারি ব্যাংকে মাত্র ৫ কোটি টাকা এফডিআর করা হয়। অন্য ২০৫ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয় তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে। এরমধ্যে একটি ব্যাংকের পৃথক ৫ শাখায় একশ কোটি টাকার বেশি রাখা হয়। একত্রে ১০০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয় নন রেসিডেন্স বাংলাদেশিজ ব্যাংকের একটি শাখায়। দুই বছর মেয়াদের এই এফডিআর করা হলেও গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিপিসি জ্বালানি তেলের বকেয়া আদায়ে শক্ত অবস্থানে গেলে যমুনা অয়েল কোম্পানি গত মার্চ মাসে এক হাজার ৯শ’ কোটি টাকা পরিশোধ করে। এরমধ্যে ১২ মার্চ আলোচিত ৮টি এফডিআর ভাঙিয়ে নেয় যমুনা অয়েল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে ভাঙানোর অজুহাতে ৭টি এফডিআরের বিপরীতে অর্ধেকের বেশি ব্যাংক সুদ থেকে বঞ্চিত হয় যমুনা অয়েল।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, এফডিআর ভাঙানোর দিন পর্যন্ত হিসেব করে যে সুদ পাওয়ার কথা তার অর্ধেকও পায়নি বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠানটি। তথ্য অনুযায়ী, ৫ কোটি টাকার একটি এফডিআরের বিপরীতে ৪৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫০ টাকার মধ্যে পায় ৩৪ লাখ ৮ হাজার ২১৮ টাকা, ৪০ কোটি টাকার একটি এফডিআরের বিপরীতে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকার মধ্যে পায় ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ৩ কোটি টাকার একটি এফডিআরের বিপরীতে ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে পায় এক কোটি ৮৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ১০ কোটি টাকার দুইটি এফডিআরের বিপরীতে এক কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছে ৬১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে। একশ কোটি টাকার এফডিআরটিতে ১৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যাংক সুদ পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছে মাত্র ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আবার ১০ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার টাকার একটি এফডিআরে এক কোটি ৪০ লাখ ৭ হাজার টাকার মধ্যে যমুনা অয়েল পায় ৬২ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৩ টাকা। তবে একটি মাত্র বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের ৫ কোটি টাকার এফডিআরের বিপরীতে প্রাপ্য ৬৪ লাখ ৬৮৪ টাকার সুদের সমুদয় পরিশোধ করে। সবমিলিয়ে ২৭ কোটি ৪৩ লাখ ৭৬ হাজার ৪৩৪ টাকা ব্যাংক সুদ প্রাপ্য হলেও পেয়েছে মাত্র ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৫৯ হাজার ২৩৬ টাকা। এতে যমুনা অয়েলের গচ্ছা গিয়েছে ১৫ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টাকা। অথচ দুই বছর মেয়াদের এসব এফডিআরের ২০-২১ মাস পর্যন্ত পার হয়েছে।
তবে অভিযোগ উঠেছে, যমুনা অয়েল এফডিআর’র বিপরীতে ১৫ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক সুদ থেকে আয় বঞ্চিত হলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে যমুনা অয়েলের কতিপয় কর্মকর্তা লাভবান হয়েছেন। ব্যাংক সুদ কম হওয়ার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রধান সাংবাদিকদের বলেন, নির্ধারিত মেয়াদের আগে এফডিআর ভাঙানো হলে সঞ্চয়ী আমানতের হিসেবে সুদ দেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তবে লং টার্ম এফডিআর করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের সাথে চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক সুদ প্রদান করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তিনি বলেন, ম্যাচিউর হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলে প্রতিষ্ঠানটি চাইলে ব্যাংক থেকে ওই এফডিআর’র বিপরীতে ঋণ নিতে পারতো। অলিখিত অর্থ লেনদেনের সুযোগের বিষয়ে এ ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজার চাইলে সাসপেন্স হিসেবে দেখিয়ে কিছু অংশ গ্রাহক কিংবা গ্রাহকের প্রতিনিধিকে দিতে পারে। যদিওবা এটি অনিয়ম।’ এবিষয়ে যমুনা অয়েলের এজিএম (হিসাব) আবুল বশর বলেন, আমরা মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙানোর কারণে চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক সুদ পাওয়া যায়নি। তবে অন্য একটি ব্যাংক থেকে সমুদয় সুদ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ওরা দিয়েছে, অন্যরা দেয়নি আরকি। তবে আমরা সব সুদ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। ব্যাংকগুলোকে আমরা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। ২১০ কোটি টাকার এফডিআর ভাঙানোর বিষয়টি স্বীকার করে ডিজিএম (অর্থ) নাজমুল হক দৈনিক জনতা কে বলেন, এগুলো বিপিসির টাকা। বিপিসির টাকা বিপিসিকে পরিশোধ করার জন্যই আমরা এফডিআরগুলো ভাঙিয়েছি। এজন্য ইন্টারেস্ট কম পাওয়া গেছে। তবে কম পাওয়া সুদগুলো আদায়ের জন্য আমরা ব্যাংকগুলোর সাথে চিঠি লেখালেখি করছি। একটি ব্যাংক কিছুটা দিয়েছেও।’
১৫ কোটি টাকা লসের বিষয়ে তিনি বলেন, এটাকে লস বলা ঠিক হবে না, এগুলো বিপিসির টাকা। যা পেয়েছি তাই আমাদের লাভ। বিপিসির টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েই আমরা এফডিআরগুলো ভাঙিয়েছি। হাটহাজারিতে এফডিআর করার বিষয়ে তিনি বলেন, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসানের নির্দেশেই করা হয়েছে। কারণ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদন ছাড়া কিছুই হয় না।