উন্নয়ন কাজে যাচ্ছে অলস অর্থ
বিশেষ প্রতিনিধি : রাষ্ট্রায়ত্ত ৬৮ সংস্থার ২ লাখ ১২ হাজার ১শ কোটি টাকা ‘অলস’ পড়ে আছে বিভিন্ন ব্যাংকে। এই ‘অলস অর্থ’ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এজন্য গত ২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে একটি খসড়া বিলে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। খসড়া আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ বাৎসরিক ব্যয় রেখে বাকি অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেবে। আর সরকার তা উন্নয়ন কাজে ব্যয় করবে।
তবে বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা এসব অর্থ সরকারি কোষাগারে নেয়া কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এসব অর্থ থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা পাচ্ছে। কিন্তু তুলে নিলে ব্যাংকের নগদ অর্থে টানাপড়ন হবে। একইসাথে কিছু অর্থ তছরুপ হওয়ার আশঙ্কাও করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং খাতের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, এই অর্থ অলস নয়, এই অর্থকে ‘অলস অর্থ’ বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। সূত্র মতে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কর্তৃক ব্যাংকে রক্ষিত অলস টাকার পরিমাণ ২১ হাজার ৫শ ৮০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) ১৮ হাজার ২শ ৪ কোটি টাকা, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ১৩ হাজার ৪শ ৫৪ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৯ হাজার ৯শ ১৩ কোটি টাকা এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জমা আছে ৪ হাজার ৩০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, এসব আমানত তুলে নিলে ব্যাংকে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, ধরুন আমার ব্যাংকে এখন ১শ টাকা আছে। কিন্তু সেখান থেকে ২০ টাকা তুলে নেয়া হলো। তাহলে ১শ টাকায় যে লাভ পাওয়া যেত ৮০ টাকায় নিশ্চয় তার চেয়ে কম লাভ হবে।
তিনি বলেন, তবে এটা সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। এ বিষয়ে এখনো কোনো চিঠি পাইনি। তাই এর প্রভাব বুঝতে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবি’র সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট হবে কিনা তা নির্ভর করবে সরকারের টাকা উত্তোলনের পদ্ধতির উপর। কারণ সরকার কী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই টাকা নেবে সেই বিষয়ে এখনো স্পষ্ট নই। তার মতে, একেবারে সব টাকা তুলে নিলে নিশ্চয়ই চাপ পড়বে। তবে ধাপে ধাপে নিলে হয়তো চাপ কম পড়বে। তিনি বলেন, টাকাটা সরকার তুলে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্টে (টিএসএ) রাখবে। সেখান থেকে হয়তো বিভিন্নভাবে আবার বিভিন্ন ব্যাংকে আসবে। কিন্তু এইভাবে তা ফিরে আসতে অনেক সময় ব্যয় হবে।
উদ্বৃত্ত এই অর্থ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তার মতে, বলা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ‘অলস’ পড়ে আছে। আসলে অলস পড়ে থাকেনি। কারণ তা বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা আছে। আর ব্যাংকগুলোও সেই অর্থ ফেলে রাখেনি। বিনিয়োগ করেছে। সেখান থেকে কিছু হলেও সুদ পাচ্ছে। অতএব এই অর্থকে অলস বলা যাবে না।
তিনি বলেন, এখন এই টাকাগুলো চলে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টিএসএতে। অর্থাৎ সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত ওই টাকা খরচ না করবে ততক্ষণ তা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা থাকবে। এর মানে দাঁড়ালো যে, বিভিন্ন ব্যাংকে জমা থাকা টাকাগুলো অলস ছিল না। কিন্তু সেগুলোকে অলস বানানো হলো। এছাড়া এই সময় তো কোনো মুনাফা পাওয়া যাবে না।
জাহিদ হোসেন আরো বলেন, বিভিন্ন ব্যাংকে জমা থাকা টাকাগুলো তুলে নেয়া হলে ব্যাংকগুলোতে অর্থের একটা সঙ্কট দেখা দেবে। তখন আমানত সংগ্রহে ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এ কারণে আমানতের সুদ হার বাড়বে। তখন কোনোভাবেই এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ সম্ভব হবে না।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বলা হচ্ছে এই অর্থ জনকল্যাণ কাজে ব্যয় করা হবে। ধরি, এখান থেকে ১ লাখ কোটি টাকা নিয়ে ৫ লাখ কোটি টাকার জনকল্যাণমূলক কাজ হাতে নেয়া হলো। কিন্তু বাকি ৪ লাখ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে।
জাহিদ হোসেনের মতে, আমি মনে করি যদি জনকল্যাণ কাজে ব্যয় করার জন্য কোনো প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয় এবং সেই প্রজেক্টে কত টাকা ব্যয় করা হবে তার সুচিন্তিত একটা কর্মসূচি প্রস্তুত করা হয়। তাহলে এসব অর্থ নেয়া যেতে পারে। কারণ তখন বলা যাবে যে, রাষ্ট্রীয় এই কাজে ৫ লাখ কোটি টাকার দরকার। অতএব এসব অর্থ ওই প্রজেক্টে ব্যয় করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের যে এডিপি তা তো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যদি বাস্তবায়নই না করা যায় তাহলে এডিপির আকার বাড়ানোর দরকার কী। তিনি বলেন, এছাড়া যেহেতু এসব অর্থ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের। তাদের যদি কোনো উন্নয়নমূলক কাজ বা বিনিয়োগের দরকার হয় তাহলে তারা তো আবার সরকারের কাছেই অর্থ চাইবে। তখন সরকার আবার অর্থ দেবে। এই অর্থ স্থানান্তরে অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পোহাতে হবে। অর্থ তছরুপ হবে। এর মানে লেনদেন বাড়লো। কিন্তু লাভ কিছুই হলো না।
তবে এই টাকা সরকারের কোষাগারে নেয়া খুব বেশি অযৌক্তিক হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আর্থিকভাবে কিছুটা চাপের মুখে রয়েছে সরকার। তাই সরকারের এই মুহূর্তে অর্থের দরকার আছে।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, একদিকে রাজস্ব আয় কমছে অন্যদিকে বাজেটে বিশাল ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি তো সরকারকে পূরণ করতে হবে। এসব বিবেচনায় সরকার এই অর্থ নিলে এটা খুব অগ্রহণযোগ্য মনে হবে না। কারণ সরকার যেসব কাজ করছে তা রাষ্ট্রের অনুকূলেই করছে। সাবেক এই গভর্নরের মতে, এই অর্থ যদি সরকার রাষ্ট্রের কল্যাণে ব্যয় করে তাহলে ভালো। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো, আমলাদের সুযোগ-সুবিধা বা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করে তাহলে তা ঠিক হবে না। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নমূলক কাজেও এই অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
ব্যাংক থেকে এসব টাকা তুলে নিলে ব্যাংক খাতে চাপ সৃষ্টি হবে কিনা জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এই টাকায় প্রতিষ্ঠান এবং উভয়ই লাভবান হচ্ছে। কারণ ব্যাংককেও এই টাকার উপর সুদ দিতে হচ্ছে। তবে এসব টাকার উপর নির্ভর হলে চলবে না ব্যাংকের। মানুষকে উপযুক্ত সেবা দিয়ে ও সুদ হার বাড়িয়ে আমানত আনতে হবে ব্যাংককে।