স্টাফ রিপোর্টার : নগদ অর্থ বা তারল্য সঙ্কটে ভুগছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দেশের ১৬টি ব্যাংক। আর তাতে ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলোর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা প্রকৃত মুনাফা হওয়ার পরও শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দেয়নি। বরং মুনাফার টাকা যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর মূলধনের ঘাটতি মেটাতে। আবার কেউ কেউ লভ্যাংশ না দিয়ে ব্যাংকের ক্যাপিটাল বাড়াচ্ছে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা ক্যাপিটাল বাড়ানোর বিষয়টি আমলে না নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বললেন, দেশের ব্যাংকগুলো দুরবস্থা আড়াল করতেই কৃত্রিম মুনাফা দেখিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ব্যাংকগুলো এমন অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখালেও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাই রাখে না। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা হারাচ্ছে শেয়ারহোল্ডার তথা পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। যার প্রভাব পড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দামেও। শেয়ারহোল্ডার, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং অর্থনীতির সাথে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা এমনই অভিযোগ করছেন।
লভ্যাংশ না দেয়ার বিষয়ে ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, মুনাফার টাকায়, মূলধন ঘাটতি মেটানো হচ্ছে, প্রভিশনিং কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর তার বদলে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দিয়েছে।
যদিও শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ, দেশের এসব ব্যাংকগুলো কাগজে-কলমে মুনাফা দেখিয়েছে। তাই নগদ লভ্যাংশ দিতে
পারছে না। লভ্যাংশ দিচ্ছে বোনাস শেয়ার।
আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার রোকন উদ্দিন বলেন, ৩ বছর আগে এবি ব্যাংকের ১০ হাজার শেয়ার কিনেছি। গত বছর লভ্যাংশ দেয়নি। এ বছর মুনাফা হয়েছে। কিন্তু ক্যাশ অর্থাৎ নগদ লভ্যাংশ দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন জানান, ব্যাংকগুলোতে এখন তারল্য সঙ্কটে চলছে এটা ঠিক। তার একটি প্রমাণ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়া। তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারী উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। তার কারণ হিসেবে তিনি জানান, বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিলে কোম্পানির মূলধন বাড়ে। কোম্পানির আর্নিং পার শেয়ারে (ইপিএস) নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা এটা প্রত্যাশা করে না। ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৬ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে মুনাফার এই টাকার নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে ১৩টি ব্যাংক। আর ১৭টি ব্যাংক নগদ অর্থ সঙ্কটের কারণে শেয়ারহোল্ডারদের বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। যার মুনাফার অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৬শ’ ৭৩ কোটি টাকার বেশি। তার মধ্যে ১৬টি ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এগুলোর বেশিরভাগই গত ২-৩ বছর ধরে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ও আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংক লিমিটেড।
বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৬টি ব্যাংকের মধ্যে বিদায়ী বছর সবচেয়ে বেশি ৫শ’ ৫৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের। ফলে কোম্পানির ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৭ টাকা। কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। এর আগের বছর ২০১৭ সালেও ২৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল। তবে তার আগের বছর ২০১৬ এবং ২০১৫ সালে যথাক্রমে ১০ ও ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।
এরপরের তালিকায় থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৪শ’ ২০ কোটি ২০ লাখ টাকা। তাতে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ০১ টাকা। কোম্পানির পরিচালনা পরিষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা দিয়েছে। এর আগের ৩ বছর ২০১৭ সালে ৩০ শতাংশ ক্যাশ (নগদ) লভ্যাংশ, ২০১৬ সালে ৩০ এবং ২০১৫ সালে ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
অন্যদিকে, সবচেয়ে কম মুনাফা হওয়ার তালিকায় থাকা এবি ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। শেয়ারের ইপিএস দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ০৬ টাকা। অর্থ সংকটে থাকা ব্যাংকটি গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এর আগের ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে সাড়ে ১২ শতাংশ করে লভ্যাংশ দিয়েছে। ব্যাংকটিতে দীর্ঘদিন ধরে নগদ অর্থ সংকট রয়েছে। সাউথইস্ট ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ২শ’ ৪৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। গত বছরও ব্যাংকটি ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। তবে তার আগের দুই বছর ২০১৬ এবং ২০১৫ সালে যথাক্রমে ২০ এবং ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। রূপালী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৪১ কোটি ৪ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে। ফলে ২০১০ সাল থেকে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। ২০১৭ সালে ২৪ এবং ২০১৬ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে।
২০১৮ সালে মুনাফা বাড়া বাকি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রিমিয়ার ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ২শ’ ২৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। ইপিএস দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৮৪ টাকায়। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ২শ’ ৯২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১শ’ ৭৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ওয়ান ব্যাংকের ১শ’ ৪১ কোটি ০৪ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩শ’ ৮৪ কোটি ৯৬ লাখ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১শ’ ২৪ কোটি ৭৪ লাখ এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ১শ’ ৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে।
এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ১শ’ ২৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকের ১শ’ ৬৪ কোটি ৬৬ লাখ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ২শ’ ৬৫ কোটি ৬৪ লাখ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ১শ’ ৫৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে। আর সেই টাকার বিপরীতে ব্যাংকগুলো শেয়ারহোল্ডারদের বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। যদিও শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ এগুলো কাগজে কলমে।
সাউথইস্ট ব্যাংকের এমডি মো. কামাল হোসাইন জানান, ক্লাসিফাইড লোনের প্রভিশনিং করতে গিয়ে বোনাস শেয়ার দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জানান, ব্যাংকগুলো ২০১৮ সালে অতিমূল্যায়িত মুনাফা দেখিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে সঠিকভাবে সঞ্চিতি গঠন করা হলে, ব্যাংকগুলো লোকসানে পতিত হবে। আর এই দুরবস্থা আড়াল করতেই কৃত্রিম মুনাফা দেখিয়েছে। আর দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ব্যাংকগুলো অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখালেও বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জানান, মুনাফার টাকায় ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতি মেটাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ক্যাপিটাল বাড়াচ্ছে। ফলে কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিচ্ছে।