স্টাফ রিপোর্টার : অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা করা পাচারকারী চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। র্যাব জানায়, বেশ কয়েকটি এজেন্সির সদস্যরা গ্রামের অল্প শিক্ষিত লোকদের বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে মাত্র ৮ লাখ টাকায় ইউরোপে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে আসছে।
গতকাল শুক্রবার অবৈধভাবে ইউরোপে পাঠানোর সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনায়জড়িত চক্রের ৩ সদস্য সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব তথ্য দেন র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে উচ্চ বেতনে বিদেশে কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে, দীর্ঘদিন যাবৎ এ ধরনের অপরাধ করে আসছে চক্রটি। এই মানবপাচারকারী চক্রটি ইউরোপ পাঠানোর জন্য ৮ লাখ টাকা করে নেয়। যার ৫ লাখ টাকা লিবিয়া যাওয়ার আগে এবং বাকি ৩ লাখ টাকা লিবিয়া যাওয়ার পর ভিকটিমের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নিচ্ছে।
র্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানো মানবপাচারকারীদের এ ধরনের ৫/৬টি এজেন্সি রয়েছে। যার দুটি এজেন্সির ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা গেছে। তারা হলেন, এনামুল হক তালুকদার, মোহাম্মদ আক্কাস মাতুব্বর, আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে, মানব পাচারকারী চক্রের এই চিহ্নিত সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়।
গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী একটি নৌকা ডুবে ৮৫ থেকে ৯০ জন নিখোঁজ হন। এর মধ্যে ৩৯ জনই ছিল বাংলাদেশি। লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার উপকূলের কাছে নৌকাটি ডুবে যায়। এই ৩৯জন গ্রেফতার হওয়া ২ এজেন্সির ৩ সদস্যের পাঠানো বাংলাদেশি ছিল। র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ঘটনার পর র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত র্যাব অভিযান চালায়। অভিযানে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর, খিলক্ষেত ও বিমানবন্দর এলাকা থেকে ৩জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এই ৩ জন হলেন শরীয়তপুরের বাসিন্দা মো. আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), সিলেটের বাসিন্দা এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও মো. আবদুর রাজ্জাক ভূইয়া। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়।
র্যাব জানায়, গ্রেফতার এনামুল ও আবদুর রাজ্জাক একটি সিন্ডিকেটের সদস্য। সিলেটের জিন্দাবাজারে এনামুল হকের ‘ইয়াহিয়া ওভারসিজ’ নামে একটি এজেন্সি আছে। তিনি ১০ থেকে ১২ বছর এভাবে মানবপাচার করে আসছেন। তার প্রতিষ্ঠানের দালাল হিসেবে কাজ করেন আবদুর রাজ্জাক। আর আক্কাস মাতুব্বর ঢাকার একটি চক্রের হয়ে কাজ করেন। তিনিও মানব পাচারের দালাল।
র্যাব জানায়, ভূমধ্যসাগরের সর্বশেষ নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ ও নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ বৃহত্তর সিলেট, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালীর বাসিন্দা। তারা কয়েকটি চক্রের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য প্রতারণার শিকার হয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্রে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে ইউরোপে মানবপাচারকারী চক্রের রুট সম্পর্কে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, প্রথমে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়াতে পাঠানো হয়। এজন্য, তারা ৩টি রুট ব্যবহার করে। প্রথমে বাসযোগে কলকাতা। কলকাতা বিমানবন্দর যোগে দিল্লীতে। দিল্লী থেকে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়। ভিকটিমরা শ্রীলঙ্কায় এজেন্টদের তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। তারপর বিমানযোগে ইস্তাম্বুল তুরস্কের ট্রানজিট হয়ে ত্রিপলী লিবিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
র্যাব জানায়, ভিকটিমরা ত্রিপলীতে পৌঁছানোর পর, সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি কথিত ‘গুড লাক ভাই’সহ আরও কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকে। ত্রিপলীতে আরো কয়েকদিন অবস্থানের পর ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজন হতে বাকি অর্থ আদায় করে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাঠানো হয়। আর এভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাওয়ার সময় ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সমপ্রতি অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের নৌপথ ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন সিন্ডিকেট এই অবৈধ কাজের সাথে যুক্ত আছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে। সর্বশেষ তিউনিসিয়া যাওয়ার পথে বাংলাদেশিদের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনায় দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের পরিবারের লোকজন শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় দুটি মামলা করেছেন।
র্যাব জানায়, এ ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং তাদের মূলোৎপাটনের জন্য র্যাব সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এযাবৎ র্যাব এসব চক্রের বিরুদ্ধে ২শ’ ৯টি অভিযান পরিচালনা করে। গ্রেফতার করে ৬শ’ ৯ জনকে। আর র্যাবের অভিযানে এ পর্যন্ত মানবপাচারের শিকার ৭শ’ ৪ জন পুরুষ ও ১শ’ ১০ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে।