বিশেষ প্রতিনিধি : গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্প-কারখানা ও পরিবহণ খাত অচল হয়ে পড়বে। বিপর্যস্ত হবে জনজীবন। অর্থনীতিতে অশনি সংকেত দেখা দেবে। ফলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দেশের উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীসহ সকলেই। বিশেষ করে গ্যাসনির্ভর শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ চরমে।
অন্যদিকে পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। কিন্তু আয় না বাড়ায় মানুষ জীবনযাত্রার মানের সাথে আপসের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। ফলে পণ্যের চাহিদা কমে যেতে পারে। এতে দেশীয় শিল্প খাতে বড় ধরনের আঘাত আসার আশঙ্কা করছেন খোদ ব্যবসায়ীরা।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়াতে হবে পণ্যের দাম। রফতানি কমারও আশঙ্কার পাশাপাশি কমে যাবে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা। বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন বিদেশি ক্রেতারা। ফলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে রফতানিমুখী শিল্প।
দেশীয় উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের তীব্র বিরোধিতার মুখেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বেশ হার্ডলাইনে রয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর ৬টি বিতরণ কোম্পানির করা আবেদনের ওপর অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক গণশুনানির শেষ দিনে গত বৃহস্পতিবার বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেছেন, যৌক্তিক হারে বাড়বে গ্যাসের দাম। বিতরণ কোম্পানিগুলো যত বেশি দাম বাড়ানোর আবেদন করুক না কেন, তা যৌক্তিক পর্যায়ে বিবেচনা করা হবে। মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুযায়ী, এবার গ্যাসের দাম গড়ে বাড়ানো হবে ১০২ শতাংশ। অর্থাৎ গ্যাসের নতুন মূল্য হবে বর্তমান মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। যার ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সব খাতে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভোক্তা, উদ্যোক্তা এবং বিদেশি ক্রেতাদের একসাথে এত বেশি মূল্য বৃদ্ধির চাপ নেয়ার সক্ষমতা নেই।
দেশের অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, শিল্প খাতে মৌলিক কাঁচামালের মতো কাজ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ। এগুলোর দাম বাড়লে সব খাতেই ব্যয় বেড়ে যাবে। ঘন ঘন গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। এতে দেশের পণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। যা বিশেষ করে দেশের রফতানি বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
একইসাথে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে জনজীবনে। এ কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি সরকারকে খুব সতর্কতার সাথে বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
এদিকে সিএনজি ফিলিং স্টেশন এন্ড কনভারশন ওয়ার্কস ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর ভূঁইয়া বলেন, সিএনজির দাম ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে ৩২ টাকার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮টাকায়। তিনি বলেন, এই মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব কী হতে পারে, কেউ ভাবছেন না। রাজধানী ঢাকায় একসময় কালো ধোঁয়ায় থাকা যেত না। সে কারণে সিএনজিতে যাওয়া হয়। তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের পরিবেশ দূষণের বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার বলে জানান।
দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা গভীর সংকটে পড়বেন। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে যখন-তখন জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করা যায় না। ফলে তিনি সরকারকে বিকল্প ভাবনা তথা ভর্তুকি দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আবেদন করার পর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সবেমাত্র গ্যাস সংযোগ পেতে শুরু করেছে। এ সময় দাম বৃদ্ধি কার স্বার্থে? তিনি অনুষ্ঠিত গণশুনানিকে হাস্যকর আখ্যা দিয়ে বলেন, সারাবিশ্বে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কমেনি।
দেশের ইস্পাত খাতের উৎপাদনে গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক বেশি। ব্যবসায়ীদের হিসাবে এক টন রড উৎপাদনে প্রায় ৭ হাজার টাকা ব্যয় হয় জ্বালানির পেছনে। প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়লে রড উৎপাদনে ব্যয় আরও ৭ হাজার টাকার মতো বাড়তে পারে ইঙ্গিত দিয়ে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং এন্ড স্টিল মিলস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শেখ মাসাদুল আলম বলেন, আগামীদিনগুলোতে ক্রেতাদের ওপর বাড়তি চাপ আসতে পারে। কারণ গ্যাসের দাম বাড়বে, ডলারের দাম বাড়ছে। নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন কার্যকর হলে করের চাপও বাড়বে।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে পরিবহণ, বিদ্যুৎ, পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সব খাতে ব্যয় বাড়বে। এই বাড়তি ব্যয়ের প্রতিটি অর্থ আবার ব্যবসায়ীরা জনগণের কাছ থেকেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে আদায় করবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির মূল্য সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে।