স্টাফ রিপোর্টার ও কক্সবাজার প্রতিনিধি : আত্মসমর্পণে সাড়া না দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে গেলে তাদের পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে বলে হুঁশিয়ারি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি আরো বলেছেন, মাদকের ব্যাপারে কাউকে ছাড় নয়। আগে দেশ বাঁচাতে হবে। আত্মগোপনে থাকা কোনও ইয়াবাকারবারি রেহাই পাবে না। বাংলাদেশকে ইয়াবামুক্ত করা হবে। যদি কোনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মাদকের সাথে জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। সীমান্ত দিয়ে কোনও প্রকার মাদক ও অবৈধ নাগরিক যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য বিজিবিকেই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে। গতকাল শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আত্মসমর্পণকারীদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, আপনারা আল্লাহর কাছে মাফ চান। আপনারা ভালো হয়ে যান। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে এগিয়ে আসুন। আর যারা এখনও আত্মসমর্পণ করেননি, তারা দ্রুত আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। না হলে ইয়াবা কারবারি যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার, জাফর আলম, আশেক উল্লাহ রফিক, সাইমুম সরওয়ার কমল, জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজুল মোস্তফাসহ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানে ১০২ জন তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন। এসব ইয়াবা কারবারিদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। এ সময় ইয়াবা কারবারিরা ৩ লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা, ৩০টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ও ৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ জমা দেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘সেফহোম’ থেকে শীর্ষ ইয়াবাকারবারিদের কক্সবাজারের টেকনাফে আত্মসমর্পণ মঞ্চে আনা হয়। মঞ্চের কাছে একটি দোতলা ভবনে তাদের রাখা হয়। আত্মসমর্পণকারীদের দেখতে তাদের স্বজন ও এলাকার হাজারো মানুষ ভিড় জমান। তালিকাভুক্ত কয়েকজন ইয়াবা কারবারিকেও অনুষ্ঠানস্থলে দর্শক হিসেবে কাছে দেখা গেছে। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, আত্মসমর্পণকারী ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে অন্তত ৩৫ জন গডফাদার রয়েছেন। আত্মসমর্পণকৃতদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধারের মামলা হবে।
আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সরকারের পক্ষ থেকে ৯টি শর্ত দেয়া হয়েছে।
শর্তগুলো হলো-
১. নিজের হেফাজতে থাকা সকল ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
২. আত্মসমর্পণের আগে দায়ের হওয়া মামলা ও বিচার কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মে চলবে।
৩. ইয়াবা ব্যবসায় নিজের/পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে অর্জিত সকল সম্পদ দুদক, সিআইডির মানি লন্ডারিং শাখা ও এনবিআরের মাধ্যমে যাচাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৪. আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় দায়ের হওয়া মামলায় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সহায়তা প্রদান করা হবে।
৫. যে সকল মাদক ব্যবসায়ী এখনো সক্রিয় তাদের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে হবে।
৬. আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকায় মাদকবিরোধী কর্মকা- করতে হবে। ৭. ভবিষ্যতে কখনো মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত হওয়া যাবে না।
৮. আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে যে মামলাটি রুজু হবে, সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে তাদেরকে আইনগত সুবিধা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
৯. মাদক ব্যবসার মাধ্যমে নিজের পরিবারের আত্মীয়-স্বজনের নামে ও বেনামে অর্জিত সকল স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি যাচাইয়ের জন্য দুদক, (সিআইডিমানিলন্ডারিং শাখা) এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সকল সংস্থার নিকট তাদের তথ্যাদি প্রেরণ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে তাদের অর্জিত সকল স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি যাচাই সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণকারী দুই ইয়াবা কারবারি তাদের অনুভূতি জানান। জীবনে আর কোনও দিন মাদক ব্যবসা করবেন না বলে ওয়াদা করেন এবং অন্যদেরও এই কারবারে না আসার অনুরোধ করেন। অনুষ্ঠান শেষে আত্মসমর্পণকারীদের কক্সবাজার পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা রুজু করে কারাগারে পাঠানোর কথা রয়েছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, দেশে প্রথমবারের মতো আত্মসমর্পণ করলেন মাদক কারবারিদের একটি অংশ। টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি সাড়ে তিন লাখ ইয়াবা ও ৩০টি পিস্তলসহ আত্মসমর্পণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে। এর মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৫৭ জন শীর্ষ ইয়াবা কারবারি। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এখনও আড়ালে থেকে যাচ্ছে ইয়াবা ও হু-ি ব্যবসায়ীদের বড় অংশ। কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা কয়েকজন ইয়াবা কারবারির বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, ইয়াবা পাচার, অর্থ লেনদেনসহ নানা বিষয়ে অনেক বড় বড় গডফাদার রয়েছে। মূলত এরাই ইয়াবা পাচারের নেপথ্যে কাজ করছে। আত্মসমর্পণকারীরা জানায়, তাদের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি বলা হলেও নেপথ্যে একটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। যে চক্রের সদস্যদের কারও নাম এখনও প্রশাসন বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনও তালিকায় আসেনি। তারা নেপথ্যে অবস্থান করে এদের (আত্মসমর্পণকারী) দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। ঐ কর্মকর্তা আরও জানান, ইতোমধ্যে আত্মসমর্পণে আসা ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিতে এমন ৩০ জন এজেন্টের নাম পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আর এ টাকা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার করা হয় দুবাই ও সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত ইয়াবার মূল মালিকদের কাছে। আর দুবাই সিঙ্গাপুর ঘুরে এ অর্থ পৌঁছানো হয় মায়ানমারে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মনে করছেন, ইয়াবা গডফাদারদের নেপথ্যে রয়েছে টাকা সংগ্রহকারী হু-ি ব্যবসায়ীরা। আর এসব হু-ি ব্যবসায়ীর নেপথ্যের ব্যক্তিরা রয়েছে দুবাই এবং সিঙ্গাপুর। ইতোমধ্যে দুবাই এবং সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া থেকেও কিছু ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করতে দেশে ফিরেছেন। ফলে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নেপথ্যের ব্যক্তিদের শনাক্ত করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানান, ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ করার পর ইয়াবাবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হবে। যে কোনোভাবে এই দেশকে মাদকমুক্ত করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। যারা আত্মসমর্পণ করে নাই, মূলত আগামীতে অভিযানগুলোই তাদের জন্য। যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন কেউ রেহাই পাবে না।
উল্লেখ্য, গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজার ও টেকনাফের ১১৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম আসে। তার মধ্যে ৭৩ জন শীর্ষ মাদক কারবারী বা পৃষ্টপোষকের নাম আছে। তালিকার মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ তার পরিবারের ২৬ জন সদস্য রয়েছে। তাছাড়া টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের নাম আছে।