সরকারি ১১ হাসপাতালে দুদকের অভিযান

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোতে কর্মরত চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত কর্মস্থলে যান না। এতে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘি্নত হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় থেকে বারবার নির্দেশ দেয়ার পরও কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি বাড়ছে না। হাসপাতালে চিকিৎসকরা উপস্থিত হচ্ছেন না এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেশের ১১টি সরকারি হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানকালে প্রায় ৬২ শতাংশ চিকিৎসককে কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। রাজধানীর একটি হাসপাতালে সেবা দিতে রোগীর কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন একজন কর্মচারী। এই অপরাধে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দুদকের ১০৬ নম্বরে (অভিযোগ কেন্দ্রে) আসা এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর নির্দেশে গতকাল সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, পাবনার মোট ১১টি সরকারি হাসপাতাল একযোগে অভিযান পরিচালনা করে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযানকালে দেখা গেছে, দেশের ৮টি জেলার ১১ হাসপাতলে ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী কর্মস্থলে চিকিৎসক থাকার কথা ২৩০ জন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ৯২ জন চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ মোট চিকিৎসকের ৪০ শতাংশ কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিতির দিক থেকে রাজধানীর বাইরের হাসপাতালগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। ঢাকার বাইরের হািসপাতালগুলোতে ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা ১৩১ জন। কিন্তু কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন ৮১ জন। অর্থাৎ চিকিৎসকের প্রায় ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না।

প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য আরো জানান, রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অভিযানকালে জরুরি বিভাগের এক কর্মচারী দায়িত্বরত অবস্থায় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণকালে দুদক টিম তাকে হাতেনাতে ধরেন। দুদক টিমের সুপারিশক্রমে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তিনি আরো বলেন, রোগীরা দুদকের টিমকে জানিয়েছে উপজেলা ও মফস্বলে পর্যাপ্ত চিকিৎসকদের নিয়োগ দেয়া হলেও তারা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা না দিয়ে বাইরে প্রাইভেট প্রাকটিসে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্গুলোতে শীর্ষ কর্মকর্তারা মাসের বেশির ভাগ সময় অনুপস্থিত থাকেন না। এ সুযোগে কনসালটেন্ট ও মেডিকেল অফিসাররাও কর্মস্থলে ঠিকমতো হাজির থাকেন না। অনেকে সপ্তাহে দু’একদিন হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে পুরো মাস অনুপস্থিত থাকেন এবং পুরো মাসের বেতন উত্তোলন করেন। দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য সেক্টরে এ অবক্ষয় অত্যন্ত দুঃখজনক। মানবসেবার চেতনা না থাকলে চিকিৎসাসেবা পরিত্যাগ করা উচিত। তবে দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে দুদক কঠোর অবস্থান নেবে। সারাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টর দুদকের নজরদারি থাকবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যঅধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি বড় অংশ নিয়মিত কর্মস্থলে হাজির হচ্ছেন না। চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক মেশিন স্থাপনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। উপস্থিতি মনিটরিং করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের একাধিক টিমও গঠন করা হয়েছে। তারপরও উপস্থিতি নিশ্চিত হচ্ছে না।

এই অবস্থায় গত বছরের ১৯ মার্চ সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (উন্নয়ন) সভাপতিত্বে এই সংক্রান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা জানান, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে মনস্তাত্তি্বক সমস্যা, কর্মস্থলে কাজ করার মানসিকতা না থাকা, জবাবদিহিতার অভাব, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অধ্যক্ষ ও পরিচালকদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাকে কনসালট্যান্টদের মানতে না চাওয়া, অনুপস্থিত চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। বৈঠকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতির যে তালিকা উপস্থাপন করা হয়, তাতে উল্লেখ করা হয় দেশের ৮টি বিভাগের সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ উপস্থিত ছিলেন না।

বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, অফিস না করে বেতন নেয়া বড় ধরনের দুর্নীতি। গণকর্মচারী শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী অনুপস্থিত থাকলে সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে দায়ী করা হবে। সঠিক সময়ে অফিস আসতে হবে, এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। কনসালট্যান্টদের নিয়মিত চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বিলম্বে অফিসে আসা, দ্রুত অফিস ত্যাগ করা এবং অনুমোদন ব্যতীত অনুপস্থিত চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালের গণকর্মচারী অধ্যাদেশ মোতাবেক শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু তাতেও কর্মস্থলে উপস্থিতির হার বাড়েনি। ফলে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।

স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬১০টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করা, কর্মস্থলে বিলম্বে উপস্থিতি হওয়া, নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কর্মস্থলে অবস্থান না করা, রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করাসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কার্যক্রম মারাত্মক বিঘি্নত হচ্ছে।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post