স্টাফ রিপোর্টার : মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে পালাতে শুরু করে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ও গডফাদাররা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি এবার ইয়াবার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে সাধারণ জনগণ। গত ৫ দিনে ইয়াবা বিক্রেতাদের কমপক্ষে এক ডজন ‘প্রাসাদ’ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তারা। হঠাৎ সাধারণ মানুষের রোষাণলে পড়ে সপরিবারে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে ইয়াবার গডফাড়াররা। সীমান্ত শহর টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও কক্সবাজার শহরের ইয়াবার বড় বড় গডফাদাররা পালিয়ে গেছে। অনেকে গোপনে পাড়ি দিয়েছে মায়ানমারে। দীর্ঘদিন পর হলেও টেকনাফের সাধারণ মানুষের ইয়াবার বিরুদ্ধে জেগে ওঠাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার টেকনাফে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী নুরুল হক ভূট্টু, নূর মোহাম্মদ ও নুরুল আবছার খোকনের রাজপ্রাসাদ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে গত ৪ দিনে প্রায় এক ডজন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর ভবন গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে ইয়াবার গডফাদার ও মাদক ব্যবসায়ীরা। এরপর সাধারণ জনগণ জেগে ওঠায় ইয়াবা কারবারীরা পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, টেকনাফ উখিয়ায় বিভিন্নস্থানে ‘রাজপ্রাসাদে’র মতো বাড়ি বানিয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এখন এইসব বাড়িতে থাকেন না তারা। টেকনাফ উখিয়া ও কক্সবাজার এলাকায় এরকম আরো শত শত আলীশান ঘরবাড়ির মালিক ইয়াবা গডফাদাররা এখন পলাতক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দুকযুদ্ধে এমপি বদির বেয়াই আকতার কামাল ও যুবলীগ নেতা একরাম কমিশনার নিহত হওয়ার পর পালিয়ে রাত কাটিয়েছে এসব আলীশান বাড়িঘরের মালিকরা। সম্প্রতি র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ার কমে আসায় ইয়াবা গডফাদাররা ঐসব রাজপ্রাসাদে অনেকই ফিরে আসে। হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা স্টেশনের পাশে নূরুল হুদার সুরম্য অট্টালিকাতেও সরব হয়ে উঠে মানুষের পদচারণায়। গত ৪ দিনে ইয়াবা বিক্রেতাদের এক ডজন ‘রাজপ্রাসাদ’ গুঁড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষ। হঠাৎ সাধারণ মানুষের রোষাণলে পড়ে সপরিবারে বহু ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে ইয়াবার গডফাড়াররা।
টেকনাফের মৌলভীপাড়া গ্রামে ঢুকতে দৃষ্টি কাড়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী আলী হোসেনের কোটি টাকায় বানানো অট্টালিকা। কিন্তু সেই বাড়িতেও এখন সুনসান নীরবতা। এলাকাবাসীর হামলার ভয়ে তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আলী হোসেনের ভাই মঞ্জুর আলমও তার বাড়ি ছেড়ে রাত কাটাচ্ছেন অন্যত্র। শুধু নুরুল বশর, আলী হোসেন ও মঞ্জুর আলমরা শুধু নয় টেকনাফে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান ও এলাকাবাসীর হামলার আতঙ্কিত হয়ে এখন ঘরছাড়া তালিকাভুক্ত ইয়াবার গডফাদাররা ও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এবার মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়ি, গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালান্সের তথ্যও সংগ্রহ করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই সুরম্য অট্টালিকার মালিকরাই আতঙ্কে আছেন সবচেয়ে বেশি। মাদকের টাকায় টেকনাফের দক্ষিণ জালিয়াপাড়া, মৌলভীপাড়া, নীলা, ডেইলপাড়া, লেঙ্গুরবিল, কুলালপাড়া ও লেদা এলাকায় গড়ে উঠেছে এমন সুরম্য শতাধিক ভবন। এসব বাড়ি নিয়ে এখন বিপদে আছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। অভিযান এড়াতে এবং স্থানীয় লোকজনের হামলার ভয়ে বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে এখন অন্যত্র বসবাস করছেন ইয়াবা গডফাদার ও মাদক ব্যবসায়ীরা। মাদকের টাকায় বানানো এসব সুরম্য ভবন পাহারা দিতে কেউ কেউ রেখে গেছেন গরিব কোনো নিকটাত্মীয়কে। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে বিজিবি চেকপোস্ট এর পাশেই আছে বিশাল জায়গাজুড়ে নির্মাণাধীন পাঁচতলার আবাসিক কটেজ। তবে এখন কাজ বন্ধ। কারণ, বাড়ির মালিক নূর মোহাম্মদ র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন আগেই। আবাসিক এই কটেজ পেরিয়ে আলিখালী রাস্তার মাথায় গেলে দেখা যাবে গোলাপি ও টিয়া রঙের দৃষ্টিনন্দন এক দ্বিতল বাড়ি। একাধিক নিরাপত্তারক্ষীর পাশাপাশি ডজনখানেক সিসিটিভি ক্যামেরাও আছে এ ভবনের চারপাশে। কিন্তু এ প্রাসাদেও এখন থাকে না কোনো ‘ইয়াবা গডফদার’। এমপি বদির বেয়াই আকতার কামাল একরাম কমিশনার বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় প্রাসাদ ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন বাড়ির মালিক নূরুল কবির। এমপি বদির ভাই তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান বাড়ি বানিয়েছেন পৌরসভার জালিয়াপাড়ায়। কিন্তু সাধের এ বাড়িতে এখন থাকতে পারছেন না তিনি।
খবর নিয়ে জানা গেল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান ও এলাকাবাসীর হামলায় আতঙ্কিত হয়ে এলাকা ছেড়ে মায়ানমারে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। টেকনাফের কুলালপাড়ায় দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল বাড়ি করেছেন তালিকাভুক্ত আরেক মাদক ব্যবসায়ী নুরুল আবছার নুরশাদ। একইভাবে লেদা এলাকায় নুরুল হুদা, চকবাজার এলাকায় সৈয়দ হোসেন, লেঙ্গরবিলে শাহজাহান মিয়া, কুলালপাড়ায় মো. কাদের, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ায় জোবাইর হোসেন করেছেন দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। সেখানে গিয়ে জানা গেল, বাড়ি ছেড়ে এখন গোপন স্থানে রাত কাটাচ্ছেন তারা। তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী হওয়ায় এমপি বদির সৎভাই মোহাম্মদ শফিক, মোহাম্মদ ফয়সাল, আবদুস শুক্কুর ও ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেলও এখন এলাকা ছাড়া। অথচ জালিয়াপাড়া ও আলিয়াবাদে অট্টালিকা আছে তাদেরও। জালিয়াপাড়ার বাড়িতে এখন থাকছেন না তাদের কেউই। মাদকের টাকায় মৌলভীপাড়ায় আবদুর রহমান ও তার ছোট ভাই একরাম গড়েছেন সুরম্য অট্টালিকা। কিন্তু তাদেরও খোঁজ মিলল না বাড়িতে। আবদুল আমিন, মোহাম্মদ আমিন ও নুরুল আমিনরা তিন ভাই। মাদক পাচার করে ডেইলপাড়ায় তিন ভাই তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। তারা কেউই এখন বাড়িতে থাকেন না। একইভাবে উখিয়ার বক্তার মেম্বার, সোনার পারার ফরিদ ও এমপি বদির ঘনিষ্ঠ উখিয়ার ২ চেয়ারম্যানসহ অর্ধশত ইয়াবা ব্যবসায়ীর দালান কোটা এখন খালি।
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ জানান, টেকনাফে ইয়াবার বিরুদ্ধে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযানে আছে। পুলিশের অভিযানের ফলে স্থানীয় জনগণও ইয়াবা গডফাদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। তিনি জানান, গত কয়েক দিনে জনগণ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একাধিক প্রাসাদ ও আস্তানা ভেঙে দিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পরে নাজির পাড়ার স্থানীয় অধিবাসীরা একাধিক ইয়াবা গডফাদারদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে পুলিশ জানতে পেরেছে। তবে এখনো পর্যন্ত এই ব্যাপারে থানায় কেউ অভিযোগ করেনি।
কঙ্বাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন জানান, দেরিতে হলেও ইয়াবার বিরুদ্ধে টেকনাফের মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠা ইতিবাচক। সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া ইয়াবা নির্মূল করা সম্ভব নয়। সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে টেকনাফ থেকে ইয়াবা নিশ্চিহ্ন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন কঙ্বাজার পুলিশের শীর্ষ এই কর্মকর্তা।