স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীতে হিজড়াদের গুরুমা’রা মাদক, অস্ত্র ও দেহ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। নগরীতে হিজড়াদের গুরুমা কচি, স্বপ্না, নাজমা, সজিব ও পিংকি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নগরীতে চাঁদাবাজি করছে। এসব ছদ্মবেশে বহুরূপী হিজড়াদের অত্যাচারে নগরবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছে। সূত্র জানায়, রাজধানীতে হিজড়ারা ছদ্মবেশে বিভিন্ন স্থানে অপরাধ ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। হিজড়ারা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তিসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধ সংঘটিত করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব হিজড়াদের মধ্যেই গুরুমা’রা শূন্য থেকে কোটিপতি বনে যাচ্ছে। রাজধানীতে হিজড়াদের কমপক্ষে ৪০ জন গুরুমা রয়েছে। তাদের মধ্যে স্বপ্না, কচি, পিংকি, সজিব ও নাজমার বিরুদ্ধে হিজড়া আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, পুরুষ জীবন ছেড়ে অপারেশনের মাধ্যমে হিজড়া হয়ে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে নামধারী এইসব হিজড়ারা। নগরীর বনানী, গুলশান, খিলক্ষেত, তুরাগ ও বাড্ডাসহ
বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি ও মারামারিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অসংখ্য মামলা ও জিডি রয়েছে হিজড়া গুরুদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও স্থানীয় বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, তেজগাঁও, রমনা, শেরেবাংলা নগরসহ বিভিন্ন থানা এলাকায় বাসাবাড়ি, দোকান, ব্যবসা কেন্দ্র এমনকি অফিসেও হানা দিচ্ছে ঐ গুরুদের শিষ্যরা। তারা আগেভাগেই ধার্য করে দিচ্ছে চাঁদার টাকা। নির্ধারিত সময়ে টাকা না দিলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাচ্ছে। শুধু তাই নয়, টাকা না পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, নগ্ননৃত্য প্রদর্শন, ভাঙচুর, মারধর করাসহ নানা অশ্লীল কাণ্ডে মেতে ওঠে তারা।
মহাখালী এলাকার আলামিন নামে এক ব্যক্তি জানান, গত ২০ ডিসেম্বর তার ভাগি্নর বিয়ে ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানে একদল হিজড়া হাজির হয়। তারা ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে বসে। পরে তাদের ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় দেয়া হয়। তবে প্রকৃত হিজড়ারা বলছেন, তারা কোনো মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন না। তারা মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খান। নকল হিজড়া এবং অপরাধীরাই এমন জবরদস্তি চালায় বলে তাদের দাবি।
এদি?কে রাজধানীর ভয়ঙ্কর পাঁচ গুরুমা রমনা থানার মগবাজার, বনানী থানার কড়াইল বস্তি, তুরাগের হরিরামপুর, খিলক্ষেতের বরুয়া এবং কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় বসবাস। অপরাধীদের মদদদাতা গুরুদের একজনের নাম কচি। কচির আসল নাম ইব্রাহিম। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল। বর্তমানে সে থাকে তুরাগের কামারপাড়া। কচির বিরুদ্ধে ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। হিজড়া সেজে নিজের বাহিনী দিয়ে নানা অপরাধ সংঘটিত করে সে এখন শূন্য থেকে কোটিপতি। উত্তরায় তিনটি বাড়ি ও নগদ কয়েক কোটি টাকার মালিক কচি। তার অধীনে কাজ করে ৪৫-৫০ জন। তুরাগের কামারপাড়া, রাজাবাড়ী, ধউর, রানাভোলা এবং বাউনিয়া এলাকায় থাকে ১০টি গ্রুপ। তাদের প্রধান হচ্ছে এই কচি। সবাই তাকে গুরুমা বলে ডাকে। কচির বিরুদ্ধে হামলা, গুলিবর্ষণসহ নানা অপকর্মের ঘটনায় তুরাগ, গাজীপুর, উত্তরা পণ্ডিম, খিলক্ষেত, বাড্ডাসহ কয়েকটি থানায় অন্তত ১৭টি মামলা রয়েছে। আরেক গুরুর নাম স্বপ্না। স্বপ্নার বসবাস মগবাজারে। তার অধীনে রয়েছে ৩৫-৪০ জন।
অভিযোগ আছে, এ শিষ্যদের অধিকাংশই পুরুষ। স্বপ্নার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেখানে সে অঢেল সম্পত্তির মালিক। স্বপ্নার আসল নাম খাইরুল। তার দুই স্ত্রী রয়েছে। কড়াইল বস্তিতে স্বপ্নার রয়েছে বিশাল বাহিনী। স্বপ্না ও কচি যৌথ সিন্ডিকেট করে রাজধানীর একাংশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। মহাখালী সাততলা বস্তিতে রয়েছে স্বপ্নার মাদক স্পট। খিলক্ষেত এলাকার হিজড়াদের দলনেতা নাজমা। তার অধীনে রয়েছে ৪০ জন। ৩০ বছর আগে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয় সে। এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিতি রয়েছে তার। প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিভিন্ন গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর কাছে তার সুদে দেয়া আছে। সায়দাবাদ, খিলক্ষেত ও গাজীপুর বোর্ডবাজার এলাকায় তার ৩টি বাড়ি ছাড়াও একাধিক প্লট রয়েছে। বটতলা ক-১৮৩/৫নং মায়ের দোয়া নাজমা ভিলায় থাকে এই নাজমা হিজড়া। এটি তার নিজের বাড়ি। মগবাজার, তেজগাঁও, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল হায়দার হিজড়ার হাতে। প্রতিপক্ষের হাতে হায়দার খুন হওয়ার পর এখন এসব এলাকার আধিপত্য চলে গেছে তারই শিষ্য সজিবের হাতে। সজিব তার দলে কিছু পুরুষকে কৃত্রিমভাবে হিজড়া বানিয়ে রেখেছে। তাদের কেউ কেউ লিঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছে। আর কোনো কোনো পুরুষকে লম্বা চুল রেখে শাড়ি পরিয়ে রাখারও অভিযোগ রয়েছে। সজিবের শিষ্যরা ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার এলাকার বাসে বীরদর্পে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। কুড়িল বিশ্বরোড, শাহজাদপুর, খিলক্ষেত, নতুন বাজার, কাওলা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে পিংকি হিজড়া। পিংকি নিজেও পুরুষ থেকে অপারেশনের মাধ্যমে হিজড়া হয়েছে। তার রয়েছে দুই শতাধিক শিষ্য। অপরাধী শিষ্যদের আয়ের টাকায় বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক এখন পিংকি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও রাজধানীকে কয়েকটি এলাকায় ভাগ করে একেকটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। উত্তরা এলাকার নিয়ন্ত্রণে রাহেলা, মিরপুরে আনুরি ও শাহজাদি এবং পুরান ঢাকায় মেজবা গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এ ব্যাপারে পিংকি হিজড়া বলেন, আমি অপরাধী হলে আইনের লোকজন আমাকে সাজা দিক। সে বলে, সব হিজড়া এভাবেই আয় করে। আমি এর বাইরে কিছু করাচ্ছি না। সজিব হিজড়া বলে, আমার লোকজন জোরজবরদস্তি করে না। আমার অধীনের এলাকা দখল করতে প্রতিপক্ষের লোকজন আমার বিরোধিতা করছে। স্বপ্না, কচি ও নাজমা তাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ঝুমা নামে এক হিজড়া জানায়, তার নাম ছিল সুমন। তাকে ফাঁদে ফেলে হিজড়া বানানো হয়েছে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য পল্লী বানিয়ে পুরস্কার পাওয়া জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম বলেন, হিজড়াদের অবহেলার দায় এড়াতে পারেন না সমাজ ও রাষ্ট্র। বেঁচে থাকার নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধাও তাদের নেই। নেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাই অনেক হিজড়া বাধ্য হয়ে নানা অপ্রীতিকর কাজে জড়ান। যদি সুস্থ মানুষ হিজড়া সেজে অপরাধে জড়ান, তাহলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে