স্টাফ রিপোর্টার : গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় অস্ত্রের যোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত শীর্ষ জঙ্গি হাদিসুর রহমান সাগরকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর ফলে এই ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্তে নতুন মোড় নিল। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সাগর গ্রেফতার হওয়ায় গুলশান হামলা সম্পর্কে আরও অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে, যা সূক্ষ্মভাবে তদন্তকাজে সাহায্য করবে।
কিছুদিন আগেও গুলশান হামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে এই শীর্ষ জঙ্গি সাগরের নামই বলেছিলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তখন তিনি বলে ছিলেন গুলশান হামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চার আসামির মধ্যে তামিম আহমেদ চৌধুরী, বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন। বাকি রয়েছেন সাগর, তিনি পলাতক। সাগরকে গ্রেফতার করা গেলেই আলোচিত এই মামলাটির তদন্তকাজ শেষ করে দ্রুত চার্জশিট জমা দেয়া সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন মনিরুল ইসলাম। সাগরকে গ্রেফতারের পর গুলশান হামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গুলশান হামলার তদন্তকাজ শেষের দিকেই ছিল। অভিযোগপত্র দেয়ার প্রস্তুতি মোটামুটি সেরে ফেলা হয়েছিল। সাগরকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে, এখন চার্জশিট দাখিলটা একটু পিছিয়ে যেতে পারে। কারণ, সাগরের কাছ থেকে হামলার বিস্তর তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে বুধবার রাত দেড়টার দিকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার অন্যতম সমন্বয়ক ও অস্ত্রের যোগানদাতা হাদিসুর রহমান সাগর এবং গত বছরের ১৫ আগস্ট রাজধানীর কলাবাগানে জাতীয় শোক দিবসের শোভাযাত্রায় হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আকরাম হোসেন খান নিলয়কে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। ঐ মোবাইল ফোনের কললিস্ট ধরে প্রাথমিক পর্যালোচনায় তাদের জঙ্গি সংশ্লিষ্ট গোপন যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান ম-ল বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বুধবার রাতে সাগর ও নিলয়কে গ্রেফতার করা হয়। তারা দু’জনই হাই-প্রোফাইল জঙ্গি। তাদের গ্রেফতারের পর কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে বিষয়টি জানানোর পর রাতেই ঢাকায় পাঠানো হয়। শীর্ষ এই জঙ্গি নেতাকে বগুড়া থেকে ঢাকায় আনার পর গুলশান হামলার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করেন। মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক হুমায়ুন কবির বলেন, গুলশান হামলার মামলার সুষ্ঠু তদন্ত এবং প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে সাগরকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিলাম। আদালত তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তিনি আরও জানান, সাগরকে নিয়ে এখন পর্যন্ত এই মামলায় সাতজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হাদিসুর রহমান সাগর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত গুলশান হামলার মাস্টার মাইন্ড জঙ্গিনেতা নুরুল ইসলাম মারজানের ভগি্নপতি। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ জঙ্গিদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে সাগরের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেলেও ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করায় এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন সাগর।
সূত্র জানায়, সাগর অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। তিনি নিজের অবস্থান সম্পর্কে সংগঠনের কাউকে কোনো সঠিক তথ্য দিতেন না। যোগাযোগ রক্ষার অ্যাপস ব্যবহারেও বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। তাই সাংগঠনিক কাজে সবার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন।
হাদিসুর রহমান সাগর জয়পুরহাটের সদর থানার কয়রাপাড়া পলিকাদোয়া গ্রামের মো. হারুন-অর রশিদের ছেলে। মারজানের বাড়ি পাবনায় হলেও তারা কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকায় এক সঙ্গেই থাকতেন। সেই সুবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও ঝিনাইদহে তার যাতায়াত ছিল। গুলশান হামলার আগে ঝিনাইদহে থাকা জঙ্গিদের আস্তানায় গিয়েছিলেন সাগর।
রিমান্ডে গ্রেফতার শীর্ষ জঙ্গি সোহেল মাহফুজ, রাজীব গান্ধী ও রাশেদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, সাগর পুরনো জেএমবির সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। একপর্যায়ে নব্য জেএমবির শুরা সদস্য মনোনীত হন। দায়িত্ব ছিল উত্তরাঞ্চলে। ভারতের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের কাজ করতেন সাগর। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো রাশেদ ও ছোট মিজানের কাছে দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। ঐ হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ নাগরিক প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি, একজন ভারতীয়, ৯ ইতালীয় এবং সাতজন জাপানি নাগরিক। প্রায় ১২ ঘণ্টার ঐ ‘জিম্মি সংকট’ শেষ হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ দিয়ে। অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। নিহত জঙ্গিরা হলেন- নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ। ঐ ঘটনার পরই দেশব্যাপী জঙ্গি বিরোধী অভিযান জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।