স্টাফ রিপোর্টার : চলতি বছরে অর্থনীতি বাড়তি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ‘রক্ষণশীল’ নীতি নেয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া ২০১৭ সালে আর্থিক দুর্বলতার পাশাপাশি ব্যাংক দখল, অর্থপাচার, দারিদ্র্য ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে যাওয়া এবং জিডিপির গুণগত প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সমালোচনা করেছে সিপিডি। গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম অন্তর্বর্র্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব মন্তব্য করেন সংস্থাটির গবেষকরা। সিপিডি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগের তুলনায় ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এখন আরও বেশি নাজুক হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন আরও ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। ঋণের ওপর কয়েকটি ব্যাংকে ব্যক্তির প্রাধান্য বিস্তার হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যক্তি খাতের নতুন ব্যাংক কার্যকর হতে পারেনি। এসব ব্যাংক থেকে বিদেশে টাকাও পাচার হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনিয়মের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া বাদে সরকার উল্টো ব্যাংক আইনে পারিবারিক ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। ব্রিফিংয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, একটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৭ সাল শুরু হয়েছিল, সেটা ছিল বিনিয়োগ বাড়ানো। কিন্তু বছর শেষে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়েনি। তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও সেই তুলনায় দারিদ্র্য কমেনি। হয়নি সেই অনুযায়ী কর্মসংস্থানও। আবার এই সময়ে সম্পদের বৈষম্যও বেড়েছে। ফলে ২০১৭ সালে সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, ২০১৭ সাল ছিল ব্যাংক খাতে কেলেঙ্কারির বছর। এই খাতে সংস্কার হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। চলতি বছর এমন ম্যাজিক্যাল কিছু ঘটবে না যাতে বড় ধরনের সংস্কার হবে। সংস্কার করার মতো রাজনৈতিক পুঁজিও নাই। গত বছরের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সঙ্গে চলতি বছরের নির্বাচন বাড়তি ঝুঁকি যোগ করবে। কারণ ২০১৮ সালের সব কর্মকা- নির্বাচনমুখী। এজন্য রক্ষণশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে হবে। ঋণ কমাতে হবে, টাকার মূল্যমান ঠিক রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে চালের দাম কমাতে হবে। নির্বাচনী বছরে বহুমুখী চাপ সামলাতে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রয়োজন।
ব্যাংক খাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ব্যাংকের সামগ্রিক সূচক আরও খারাপ হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ঋণের টাকা কয়েক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার জায়গা প্রশাসনিকভাবে বেশ কিছু ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ বা সংস্কার করতে পারেনি। সংস্কারের পরিবর্তে আরও উল্টো দিকে গেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিবারের হাতে ব্যাংকগুলোকে জিম্মি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় দায়ী। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংস্কারের উদ্যোগের অভাব ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়।
সিপিডি’র আরেক সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে তুলা আমদানি ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। যদিও উৎপাদনে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে ৮০ ভাগই আমদানি-রফতানি মূল্য কারসাজির মাধ্যমে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) খতিয়ে দেখা উচিত। মিডিয়া ব্রিফিংয়ে অন্যদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন- সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।