নরসিংদী থেকে কামরুল ইসলাম কামাল : নরসিংদীতে নারী ও শিশু ধর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলছে। ৫-৬ বছরের শিশু থেকে মধ্য বয়সী নারী পর্যন্ত কেউ ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বেসরকারি হিসেব মতে ২০১৭ সালে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় কমবেশি ২শ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তবে সরকারিভাবে রেকর্ড করা হয়েছে ১শ ২৮টি ধর্ষণের ঘটনা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জরিপ অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশের ৬৪টি জেলায় ৮১৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র নরসিংদীতেই ঘটেছে ১২৮টি ঘটনা। দেশের কোন জেলায় কত সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারণা ২০১৭ সালে নরসিংদী জেলায়ই সর্বোচ্চ সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী দেশের ৬৪টি জেলায় যদি ৮১৮টি ধর্ষণ হয়ে থাকে।
তবে গড়ে প্রতি জেলায় ধর্ষণের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ জনের কিছু উপরে। এক্ষেত্রে একেকটি জেলার চেয়ে নরসিংদীতে ধর্ষণের হার হচ্ছে ১০ গুণের চেয়েও বেশি। এছাড়া গত ১০ বছরের রেকর্ড অনুযায়ী প্রতি বছরই ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৮ সালে ধর্ষণ হয়েছে ২৪টি, ২০০৯ সালে ৪৬টি, ২০১০ সালে ৭৫টি, ২০১১ সালে ৭৬টি, ২০১২ সালে ১০৯টি, ২০১৩ সালে ১২০টি, ২০১৪ সালে ১৭৬টি, ২০১৫ সালে ১৮০টি, ২০১৬ সালে ১২৭টি এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে ১২৮টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী গত ১০ বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৬১টি। বেসরকারি হিসেব মতে জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কমবেশি ২ হাজার। লোক লজ্জা ও প্রভাবশালী ধর্ষকচক্রের ভয়ে অনেকেই থানায় মামলা করতে সাহস পায়নি। নরসিংদীতে ধর্ষণের ঘটনা বাড়লেও মামলা এবং বিচার হচ্ছে খুবই কম। বেশিরভাগ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে গরিব নিম্ন আয়ের পরিবারের মেয়েরা। পক্ষান্তরে যারা ধর্ষণ করছে তারা হচ্ছে সমাজের প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং তাদের পুত্ররা।
এসব প্রভাবশালীরা গোড়া থেকেই অধিকাংশ মামলা নষ্ট করে দিচ্ছে। যার ফলে বেশিরভাগ মামলা পরিবার থেকে থানা এবং থানা থেকে আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারছে না। যেসব মামলা চার্জশীট হয়ে আদালত পর্যন্ত যাচ্ছে সেসব মামলাও ধর্ষিতারা ধরে রাখতে পারছে না। থানা থেকে মামলা কোনো রকমে চার্জশীট হয়ে কোর্টে যাবার পরও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মামলা প্রতাহারের জন্য বাদীপক্ষকে অব্যাহত চাপের উপর রাখছে। যার ফলে যেসব মামলা নিশ্চিতভাবে সাজা হতো সেসব মামলাগুলোও চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্নমুখী চাপের কারণে বাদীপক্ষ উল্টাপাল্টা সাক্ষী দিয়ে ধর্ষকদের বাঁচিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে বছরে ২-৪ টির বেশি ধর্ষণ ঘটনার বিচার হতে দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাই মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে।
কিছু ধর্ষণের ঘটনা মীমাংসা হচ্ছে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে। ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী নেতারা ধর্ষণের পর বিভিন্নমুখী অপকৌশল করে মামলাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে দিচ্ছে। ধর্ষণের পর আলামত নষ্ট করার জন্য ধর্ষিতাদের ২-৩ দিন করে আটকে রাখছে।
জোর করে ধর্ষিতাদের গোসল করিয়ে দিচ্ছে। ধর্ষিতাদের কাপড়চোপড় কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আলামত থাকতে নির্ধারিত সময়ে যেন মেডিকেল পরীক্ষা না হতে পারে সেজন্যে অপকৌশল করে ধর্ষিতাদের আইনের আশ্রয়ের পথে বিভিন্নমুখী বাধা সৃষ্টি করছে। মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের টাকা দিয়ে কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সঠিক সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে দিচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেডিকেল পরীক্ষার আলামত নষ্ট কিংবা ফলাফল ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রভাবিত করছে। তাছাড়া, মামলা আপোস হতে রাজি না হলে ধর্ষিতা কিংবা তার পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে মামলা আপোস করতে বাধ্য করছে।
এ কারণে সরকার ধর্ষণ ঘটনার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করার পরও ধর্ষণের সংখ্যা কমছে না। দিনের পর দিন ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। বিশেষ নরসিংদীর শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা বেশ ঘটছে। ধর্ষণ যৌন হয়রানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন থাকার পরও মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে নিরাপত্তা পাচ্ছে না।
ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই ধর্ষকদের পরিবর্তে ধর্ষিতাদের উপর দোষারূপ করা হচ্ছে। নিরাপত্তার অভাবে মেয়েরা একা কর্মস্থলে যেতে পারছে না। কর্মস্থল থেকে বাড়ি যেতে পারছে না। পথের মধ্যে থেকেই অপহরণ করে জোরপূর্বক ধর্ষণ করছে মেয়েদের। ধর্ষকদের ভয়ে গ্রামের মেয়েরাও নিরাপত্তা পাচ্ছে না। মেয়েরা স্কুল থেকে গায়ের পথে একা একা বাড়ি ফিরতে পারছে না। আবার বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে পারছে না।
সার্বিক অবস্থায় অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, স্মার্টফোনগুলোতে নগ্ন ছবি, অবাধ যৌন ক্রিয়ার ছবি ও মুভি দেখে দেখে উঠতি বয়সের ছেলেরা কার্মাত কুকুরের মতো পাগল হয়ে ধর্ষণের দিকে ঝুঁকে পরছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত স্মার্টফোনগুলোতে অবাধ যৌন ক্রিয়ার ছবি দেখছে স্কুল, কলেজগামী কিংবা কর্মজীবী ছেলেরা। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে এসব নগ্ন ও নীল ছবিই ধর্ষণ ঘটনার পেছনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।