রোহিঙ্গাদের নিয়ে সঙ্কটে দেশ

rohinga

জড়াচ্ছে অপরাধে ধ্বংসের মুখে পর্যটন শিল্প স্থানীয়রা প্রথম আগ্রহ নিয়ে আশ্রয় দিলেও এখন তারা গলার কাঁটা

বিশেষ প্রতিনিধি : টেকনাফ ও উখিয়া থানা মিলে গত ১ মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের অন্তত ৩০টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ৩০ জন রোহিঙ্গাকে। মায়ানমার থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর তুলনায় অপরাধের ঘটনা কম হলেও তা ক্রমেই আতঙ্ক ও উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। ত্রাণ সহায়তাকারী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীদের সাথে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি মৌসুমে প্রায় ১০ লাখ পর্যটকের বাজার হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। মায়ানমারের রাখাইনে উত্তপ্ত পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে কঙ্বাজারের টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। গত ২ মাস ধরে এই রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় পর্যটকদের উপস্থিতিও কমে গেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাহাজ চলাচল শুরু করতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক বসলেও সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়েছে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয়রা কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তা ফুটে উঠে উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দীন চৌধুরীর কথায়। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় লোকজনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাদের অপরাধ কর্মে বিষিয়ে উঠছে এলাকার পরিবেশ। এতে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে স্থানীয়দের জীবন। সঙ্কট দ্রুত সমাধান না হলে অদূর ভবিষ্যতে এই রোহিঙ্গারা দেশের জন্য চরম দুর্যোগ ডেকে আনবে।

সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও তার স্থায়িত্ব যেন দীর্ঘায়িত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। যদি এ সঙ্কটের সুরাহা দ্রুত সময়ের মধ্যে না হয়, দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে ধ্বংসের মুখে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পর্যটন শিল্প। যার ফলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতিও।

এদিকে রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভেতরে উগ্রতা বা রুক্ষতা থাকা স্বাভাবিক। কারণ, তারা নির্যাতিত হয়েছেন। নিজেদের সামনে স্বজনদের হত্যার শিকার হতে দেখেছেন। কিছু কিছু রোহিঙ্গা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তারা হত্যাকা-ের মতো অপরাধও করছে। তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। আমরা ফোর্স বাড়িয়েছি। সরকারের অন্যান্য সংস্থাও কাজ করছে।

তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন যে পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। তাদের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে সন্ধ্যার পর ক্যাম্পগুলোর আশপাশেও অবস্থান করা যায় না। তাছাড়া আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে বলেও শোরগোল ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।

ইতোমধ্যে খুন, ডাকাতি, বনভূমি দখলসহ হেন কোনো কাজ নেই যার সাথে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে যায়নি। ইয়াবা, মানবপাচারেও জড়িয়ে পড়ছে তারা। স্থানীয়রা প্রথম প্রথম আগ্রহ নিয়ে আশ্রয় দিলেও এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গারা। শুধু সাধারণ জনগণই তাদের লক্ষ্যবস্তু তা কিন্তু নয়, বাদ যাচ্ছেন না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও। খুনসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনায় যুক্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নাম। এমনকি অনেক বিশ্লেষক বলছেন, তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জঙ্গিবাদ দানা বাঁধতে শুরু করলে তা আশ্চর্য হবার মতো ঘটনা হবে না।

এদিকে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দীর্ঘকাল অবস্থান করলে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সঙ্কটে এ ৩ ধরনের সমস্যা হতে পারে। জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কার কথা বাদ দিলেও দীর্ঘকাল এখানে অবস্থানের ফলে কাজকর্ম না থাকলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর এই মানুষগুলোকে দীর্ঘকাল বাংলাদেশের পক্ষে খাইয়ে-পরিয়ে রাখা এক বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয়ভাবে তারা প্রভাব বিস্তারও করতে পারে। অতীতেও এমন রেকর্ড আছে। অনেককে রাজনৈতিক বিবেচনায় পুনর্বাসন করা হয়েছে। যা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করবে।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি মৌসুমে পর্যটক হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। মায়ানমারের রাখাইনে উত্তপ্ত পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে কঙ্বাজারের টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে গত ২ মাস ধরে। ঐ রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় পর্যটকদের উপস্থিতিও অস্বাভাবিকহারে কমে গেছে। চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাহাজ চলাচল শুরু করতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক বসলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে নৌমন্ত্রী বৈঠক করে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে বৈঠকে জানানো হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিস্নউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত পেন্ডিং থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে নৌ মন্ত্রণালয় কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় সুপারিশ করা হয়েছে যে, নৌ পরিবহণ মন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলে সেন্ট মার্টিনে জাহাজ চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড় দিলেই জাহাজ চলাচল শুরু হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সমুদ্র শান্ত থাকায় প্রায় ১০ লাখ পর্যটক টেকনাফ থেকে জাহাজে সেন্টমার্টিনে যাতায়াত করেন। কিন্তু মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসায় সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে টানাপড়েনের কারণে এ রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সেন্টমার্টিন ভিত্তিক পর্যটন শিল্পে।

বৈঠকে জানানো হয়, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন নৌ পথের দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল। মায়ানমারের সীমান্তবর্তী নাফ নদী হয়ে যেতে হয় প্রায় ২৪ নটিক্যাল মাইল। সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় ১০ নটিক্যাল মাইল। নাফ নদীর অংশ পার হওয়ার সময় মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা একাধিকবার বাংলাদেশি নৌযানে গুলি চালায়। এ পরিস্থিতিতে মাছ ধরার ট্রলারের পাশাপাশি যাত্রী ও পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়।

সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর ‘ট্যুর অপারেটরস-কঙ্বাজারে’র যুগ্ম আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে ২ মাস ধরে। এতে করে এ মৌসুমে দেশি প্রায় ১০ লাখ পর্যটক বাইরের দেশে চলে যাবেন। ইতোমধ্যেই অনেক পর্যটক বাইরে চলে গেছেন। এছাড়া জাহাজ চলাচল না করায় ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন অনিশ্চতার মধ্যে। দ্রুত বিজিবি ও নাসাকার সাথে পতাকা বৈঠক করে জাহাজ চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক পর্যটন সূত্র জানিয়ে, প্রতি বছর অক্টোবরের শুরু থেকে পরের বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত এই রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু এখন তা বন্ধ রয়েছে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হালনাগাদ করা সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলার ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬ লাখ ৭ হাজার। যার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। শুধুমাত্র ১ নভেম্বর গত বৃহস্পতিবার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন ৫ হাজার রোহিঙ্গা। পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গারা জানান, বাংলাদেশের পথে রয়েছেন অন্তত আরও ২০ হাজার রোহিঙ্গা

 

Post a Comment

Previous Post Next Post