পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ মামলা ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল

পিলখানায়

হাবিবুর রহমান : পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা মামলায় ১৩৯ আসামির ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ আসামির মধ্যে ১৪৬ আসামির যাবজ্জীবনের সাজা বহাল রেখে রায় দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি বিচারিক আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জনের সাজা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা ফৌজদারি আপিলের প্রেক্ষিতে সাজা বাড়িয়ে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এ মামলায় সাড়ে ৮শ আসামির মধ্যে আরো ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছিল জজ আদালত। তাদের মধ্যে ১৮২ জনকে ১০ বছরের কারাদন্ড, ৮ জনকে ৭ বছরের কারাদন্ড, ৪ জনকে ৩ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে হাইকোর্ট।

এ মামলায় বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণার পর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল ৩৭০ কার্যদিবসে সেই শুনানি শেষ হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল। অন্যদিকে আসামিপক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এস এম শাহজাহান, এএসএম আবদুল মুবিন, মো. আমিনুল ইসলাম, দাউদুর রহমান মিনা, শামীম সরদার প্রমুখ।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে ৫৭ জন সেনা সদস্যসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ জন বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে ৮৪০ জন আসামির মধ্যে আরও ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫১ জনকে ৩ থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড এবং ২৭৭ জনকে খালাস দেয়া হয়। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে খালাসপ্রাপ্ত ২৭৭ জনের মধ্যে ৬৯ জন আসামির সাজা চেয়ে হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দায়ের করেন রাষ্ট্রপক্ষ।

অন্যদিকে দন্ড প্রাপ্ত ৪১০ জন আসামির সাজা বাতিল চেয়ে রায়ের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন তাদের আইনজীবীরা। পরে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত কয়েকজনের মৃত্যুদন্ড ও কয়েকজনের সাজা বাড়াতে আরও দু’টি আবেদন জানিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ। তবে দেরিতে আবেদন করায় গত ১৩ এপ্রিল আবেদন দু’টি বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে গত ৬ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের বাতিলের আদেশটিই বহাল রাখেন।

২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি মামলার সকল ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চটি গঠন করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। পরদিন ৫ জানুয়ারি বসে ১৮ জানুয়ারি শুনানি শুরুর দিন ধার্য করেন হাইকোর্টের ঐ বিশেষ বেঞ্চ।

গতকাল রোববার সকাল ১০টা ৫৬ মিনিটে এ মামলার রায় পড়া শুরু করে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ। দুপুর ১টা থেকে এক ঘণ্টার বিরতির পর বিকাল ৪টা পর্যন্ত রায় পড়ে শোনায় আদালত। বেঞ্চের অপর ২ সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

এ মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডের সাজা পাওয়া আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য ২০১৫ সালে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়। গত ১৩ এপ্রিল উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়। এরপর রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয় মামলাটি। এই মামলায় দীর্ঘ ৩৭০ কার্যদিবস শুনানি হয় হাইকোর্টে। গত ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণার জন্য ২৬ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করেছিলেন আদালত।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরোয়ার কাজল। আসামিপক্ষে ছিলেন এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এস এম শাহজাহান ও আমিনুল ইসলাম।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীকে যাবজ্জীবন দন্ড দেন আদালত। তাদের দুজনকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ৫ বছর কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছিলেন বিচারক। নাসির উদ্দিন পিন্টু কারাগারে থাকাকালে মারা যান। ১৬১ জন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের পাশাপাশি অস্ত্র লুটের দায়ে আরো ১০ বছরের কারাদ- এবং ২০ হাজার টাকা জারিমানা, অনাদায়ে আরো ২ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। তাদের পর্যায়ক্রমে এই সাজা খাটতে হবে। এ ছাড়া ২৫৬ আসামিকে ৩ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ- ও অর্থদ- দেয়া হয়। কারো কারো সাজা হয়েছে একাধিক ধারায়। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেন বিচারক। বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ঘটনায় প্রথমে লালবাগ থানায় মামলা হয়। পরে তা স্থানান্তরিত হয় নিউমার্কেট থানায়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিআইডি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেয়ায় আলাদাভাবে দুই অভিযোগের বিচার শুরু হয়।

হত্যার ঘটনায় অভিযোগপত্র দেয়া হয় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ছাড়া বিস্ফোরক আইনে ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়।

২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি হত্য মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ঢাকার বিশেষ জজ জহুরুল হক। ঐ বছরের ২৪ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। পরে এ মামলার দায়িত্ব পান মো. আখতারুজ্জামান। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক ও বর্তমান সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান আইজি, বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ১ হাজার ৩৪৫ জনকে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী করা হলেও শেষ পর্যন্ত ৬৫৪ জন আদালতে জবানবন্দি দেন।

 

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post