ভয়ঙ্কর নেশা ইয়াবার ছড়াছড়ি

 ইয়াবার

নিত্যনতুন কৌশলে পাচার হয়ে আসা মাদকদ্রব্য ধরতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন

হাবিবুর রহমান : রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়ঙ্কর নেশা ইয়াবার ছড়াছড়ি। দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গেছে ইয়াবা নামের মরণনেশা। গড়ে উঠেছে ইয়াবা সিন্ডিকেট। একেকটি সিন্ডিকেটের অধীনে রয়েছে অনেক ব্যবসায়ী ও এজেন্ট। ইয়াবাসহ যেকোনো মাদক ব্যবসায়ীর প্রধান লক্ষ্য উঠতি বয়সী কিশোর ও তরুণরা। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে কী, তা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয়। দিনে দিনে মাদকাসক্ত তথা ইয়াবা আসক্তরা জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে। নিজেদের নেশার অর্থ জোগাড় করতে নিজেরাই একসময় বাহক কিংবা বিক্রেতা হয়ে যায়। এভাবেই সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়তে থাকে। সমাজের বিত্তবান ও ভদ্র ঘরের সন্তানদের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরাও সর্বনাশা এ নেশার জগৎ ঘিরে গড়ে তোলে বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট। বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট হলেও মাদকের বিস্তার রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে দু’একজন মাদক বিক্রেতা ধরা পড়লেও এই ব্যবসার মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়ঙ্কর মাদকের আগ্রাসনে বিপথগামী যুবক, তরুণ-তরুণীসহ প্রায় সব বয়সী মানুষ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অলি-গলি, মোড়ে মোড়ে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদক। পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, সিআইডি, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব সংস্থার সদস্যরা রাত-দিন মাদকবিরোধী অভিযানে থাকেন। প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার পিস ইয়াবা ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য জব্দ হয়। কিন্তু কিছুতেই যেন বন্ধ হচ্ছে না মাদকের স্রোত।

সূত্র আরও জানায়, মাদকবাজারে কেনাবেচার শীর্ষে রয়েছে সর্বগ্রাসী ইয়াবা। দেশজুড়ে চলছে ইয়াবার বাজার। নতুন প্রজন্ম রীতিমতো ইয়াবার প্রেমে উন্মাদ। রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ইয়াবার অভিন্ন আস্তানা গজিয়ে উঠছে। মাদকটি আকারে ছোট হওয়ায় সহজে বহন করা যায়। এ কারণে অন্য মাদকের তুলনায় ইয়াবা সেবনকারী ও বিক্রেতারা খুব সহজে নিরাপদে সেবন ও বিক্রয় করতে পারে। ভয়ঙ্কর তথ্য হলো দিন দিন ইয়াবা আসক্ত তরুণীর স্যংখা বাড়ছে। খারাপ ও ধনীর বখে যাওয়া ছেলে বন্ধু বা মেয়ে বন্ধুর মাধ্যমে অনেকেই এই জগতে প্রবেশ করছে। অনেকে আবার স্রেফ কৌতূহলের বশেও দু’একবার ইয়াবা সেবন করে স্থায়ীভাবে ইয়াবাতে আসক্ত হয়ে পড়ে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই রয়েছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ইয়াবার ভয়াবহতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল সব মহলকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। নিত্য নতুন কৌশলে পাচার হয়ে আসা মাদকদ্রব্য ধরতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। সারাদেশে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অব্যাহত অভিযান সত্ত্বেও মাদকের আগ্রাসী থাবা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারি কঠোর ব্যবস্থাপনার মধ্যে মাদক ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে, সচল থাকছে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাও। মাদক আমদানি, সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে তারা। এসব নিত্য নতুন কৌশল গ্রহণকারী মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। ইদানীং বাকপ্রতিবন্ধীদের মাধ্যমেও পাচার হচ্ছে ইয়াবা। এতে ইয়াবাসহ বাকপ্রতিবন্ধীরা ধরা পড়লেও তারা মূল মাদক ব্যবসায়ীর নাম-পরিচয় কিছুই জানাতে পারে না, দিতে পারে না কোনো জবানবন্দী। অন্যদিকে একশ্রেণীর হিজড়ারা আনা-নেয়া করছে ফেনসিডিল। তাছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের স্টিকার লাগানো গাড়ি, সেনা কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসন ও পুলিশের প্লেট লাগানো গাড়ি ব্যবহার করেও মাদক পাচার করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের আভ্যন্তরীণ ৪৭টি রুটের যানবাহন ও ট্রেনে অবাধে মাদক আনা-নেয়া চললেও খুবই সীমিত পরিমাণ মাদক আটক করতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, কুরিয়ার সার্ভিসে, ওষুধের বোতলে, মাছের পেটে, এম্বুলেন্সে, পণ্যের কন্টেইনারে, ইলেক্ট্রিক ডিভাইসের ভেতরে লুকিয়ে ইয়াবা বহন করা হচ্ছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ৩০ হাজার ইয়াবার একটি চালান ঢাকায় পাঠানো হয় কুরিয়ারের মাধ্যমে। চালানটি রিসিভ করে নিয়ে আসা হয় পান্থপথের একটি হোটেলে। এরপর সেগুলো ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় একই পরিবারের ৪ জনসহ ৬ জনকে আটক করে র‌্যাব-২। পরে তাদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে ২ লাখ ৬ হাজার ৬শ টাকা ও ৮ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার (স্পেশাল কোম্পানি) মেজর মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, আমাদের কাছে চট্টগ্রাম থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে ইয়াবার বড় চালান আসার তথ্য ছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা কুরিয়ার সার্ভিসের এখানে (অফিসে) অবস্থান নেই। কিন্তু দু’টি চালান নিয়ে ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে কৌশলে কেটে পড়ে। পরে আমরা জানতে পারি, তারা এই চালান নিয়ে পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেনে অবস্থান করছে। হোটেলে অভিযান চালিয়ে একটি কক্ষ থেকে ৫ জন ও হোটেল ম্যানেজারকে আটক করি। এ সময় তাদের কাছ থেকে ইয়াবা বিক্রির অ্যাডভান্স ২ লাখ ৬ হাজার ৬শ টাকা উদ্ধার করি। এরপর কুরিয়ার থেকে ইয়াবার আরেকটি চালান তাদের মাধ্যমে ডেলিভারি গ্রহণ করিয়ে ৮ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করি।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এম্বুলেন্সে করেও চোরাচালান নিয়ে আসে। র‌্যাব ও পুলিশ এ ধরনের বেশ কয়েকটি চালান আটক করেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে রিসার্চ, ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের (আরটিএম) ড্রাইভার বাদশা মিয়াকে ১৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করে উখিয়া থানা পুলিশ। তিনি এম্বুলেন্সে করে ইয়াবার চালান পাচার করছিলেন। ওষুধের বোতলে করে ইয়াবা চালান বহন করা হয় বলে জানান এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করে। আমরাও সেগুলো ধরার জন্য ছুটে বেড়াই। তিনি জানান, গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ৩০ হাজার পিস ইয়াবাসহ ১ জনকে আটক করা হয়। সে কার্টনের মধ্যে প্লাস্টিকের বোতলে ইয়াবা ঢুকিয়ে বহন করছিল। নিরাপদে বহন করার জন্য এ পথ অবলম্বন করে সে।

বাহকরা সমপ্রতি পেটে করেও ইয়াবা বহন করছে বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা। তিনি বলেন, পেটে করে ইয়াবা পাচার নতুন কৌশল। আগে খুব কম হলেও বর্তমানে তা বেড়েছে। পেটে করে বাহকরা সর্বোচ্চ আড়াই হাজার পর্যন্ত ইয়াবা বহন করছে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে তার মধ্যে মাদক নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। সারাদেশে র‌্যাব প্রতিনিয়ত মাদক উদ্ধার করে চলেছে। আমাদের সীমিত জনবলের মধ্যেও ভয়ঙ্কর এসব নেশাদ্রব্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post