মো: কামরুল হাসান :দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম ঠিক তখনই ২৮ টাকা হালি মূল্যের ডিম মাত্র ১২ টাকায় পাওয়া ছিলো অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতো মহা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। সস্তায় ডিম পাওয়ার আভাস দিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই গণমাধ্যমগুলোতে মাত্র ৩ টাকা মূল্যে ডিম বিক্রির ঘোষণা দেয়া হয়। আয়োজকদের প্রচারণার কৌশল এতটাই শক্ত ছিল যে দেশ ছাপিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় ঐ তিন টাকায় ডিম বিক্রির এ সংবাদ। আয়োজকরা জানিয়েছিলেন, সবার কাছে ডিম পৌঁছে দেয়াই ছিলো এই আয়োজনের লক্ষ্য। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই ডিম বিতরণ ও কেনাকে কেন্দ্র করে গতকাল রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়িস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে ঘটে গেলো লঙ্কাকান্ড। দুর্মূল্যের বাজারে ৩ টাকায় ডিম পেতে ভোর থেকে নেমেছিল জনতার ঢল। যা দেখে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় আয়োজকরা। জনপ্রতি ৯০টি করে বিক্রির কথা বলা হলেও জনতার ঢল দেখে আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্যাকেট করা হয় ২০টি করে। তারপরও এই ঢল সামাল দেয়া যাবে না নিশ্চিত হয়েই আয়োজকরাই ডিম বিতরণে সৃষ্টি করেন অব্যবস্থাপনা। যার ফলে তৈরি হয় অরাজক পরিবেশ। হুড়োহুড়ি আর ধাক্কাধাক্কিতে ডিম দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয় মিনিট বিশেক পরেই। ধাক্কাধাক্কিতে একপর্যায়ে ভেঙে পড়ে ডিম বিতরণের জন্য তৈরি অস্থায়ী মঞ্চ। শুরু হয় হুলুস্থুল আর ঠেলাঠেলি। সেই সাথে ভাঙলো কয়েক ডজন ডিম। এরপরই বেজে উঠলো পুলিশের বাঁশি। তারপর লাঠিচার্জ। ক্রেতাদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশ ও আয়োজকদের। তবে বাঁশি বাজিয়ে আধাঘণ্টার মধ্যেই খালি করে দেয়া হলো মেলা প্রাঙ্গণ।
গতকাল যৌথভাবে ডিম মেলার আয়োজন করে বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে মাত্র ১২ টাকা হালিতে ডিম বিক্রির ঘোষণা দিয়ে আয়োজকরা জানান, মেলার দিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা প্রতিটি ডিম মাত্র ৩ টাকায় বিক্রি হবে। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে এই ডিম বিক্রি করা হবে।
পোস্টার থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় আয়োজকদের পক্ষ থেকে। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসহ বিদেশের গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় এই সংবাদ। ‘তিন ঘণ্টার জন্য ডিমের দামে বিপুল ছাড় ঢাকায়’-ঠিক এমনি শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছে খোদ ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাও।
ফলে আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল ডিম মেলায় সাধারণ মানুষের বিপুল সাড়া পাওয়া যাবে। বাস্তবে ঘটেও তাই। কাকডাকা ভোর থেকেই ডিম কিনতে ক্রেতারা খামারবাড়িতে জড়ো হতে থাকে। খামারবাড়ি থেকে বিজয় সরণি, সংসদ ভবন পর্যন্ত দীর্ঘ লাইন ছাড়িয়ে যায়। সেই সাথে এই লাইন খামারবাড়ির আশেপাশের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। সকাল ৯টার আগেই এ লাইন ২ কিলোমিটারের বেশি ছাড়িয়ে যায়। অনেকেই স্ত্রী, ছেলেসন্তান নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে যান। কিন্তু দুর্মূল্যের এই বাজারে সস্তার ডিম জুটলো না। ভোর থেকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যারা অপেক্ষা করেছিলেন এরপর খালি হাতে ফিরে যেতে হয় তাদের। শুধু তাই নয় ডিম না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ জনতা ধাওয়া করে ডিমের গাড়ি।
সেই কোন ভোরবেলা থেকে ডিম কিনবেন বলে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের একজন ছাত্র মোহাম্মদ সোহেল। তিনি বলছেন, এই দেখেন আমি মাত্র একটা ডিম পেয়েছি। ভাবলাম ছুটির দিন একটু মজা করে ঘুরবো। আবার যাবার সময় সাথে করে ডিমও নিয়ে যাবো। কিন্তু তার বদলে উল্টো হয়রানির শিকার হলাম।
পাশেই দাঁড়িয়ে ফোড়ন কাটছিলেন আর হাসছিলেন উত্তরার বাসিন্দা ফারজানা শিরিন। তিনি বলছিলেন, উনি তো তাও একটা পেয়েছেন। আমিতো একটাও পাইনি। এর চেয়ে ভালো হতো যদি ছুটির দিনটা বরং ঘুমিয়েই কাটাতাম।
উত্তরা থেকে আসা আরেকজন ক্রেতা সুমন বলেন, প্রচন্ড ভিড় হবে সেটা আগেই বুঝেছিলাম, সে কারণেই খুব ভোরে এসেছিলাম। কিন্তু মেলার আয়োজকদের মধ্যে ডিম বিতরণের কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না। তারা শুধুমাত্র নিজেদের প্রচারণা চেয়েছিলেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা মেলায় হট্টগোল পাকিয়ে সবকিছু পন্ড করে দিয়ে আমাদের হয়রানি করেছেন।
কয়েক ডজন ডিম কিনতে এসে কেন লাঠিপেটা? এমনি প্রশ্ন তুলে রীতিমতো ক্ষোভে ফেটে পড়েন অনেকে। এত ডিম কোথায় গেলো উঠলো সেই প্রশ্নও। যদি ডিম দেয়ার সক্ষমতা না থাকে তবে কেন এত প্রচারণা। এত প্রচার প্রচারণা করে কেনই বা ডেকে এনে সাধারণ মানুষদের পুলিশ দিয়ে পেটানো হলো।
ডিম কিনতে আসা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তমাল বলেন, ডিম দিতে পারবে না তাহলে আয়োজন করেছে কেন? তাদের বোঝা উচিত ঢাকায় কত লোক বাস করে আর কেমন চাহিদা। আয়োজকদের আমাদের নিয়ে এমন তামশা করা মোটেই উচিত হয়নি। সামর্থ্যে না কুলোলে এমনটা করাই অন্যায়।
আবার অনেকেই ডিম কিনতে না পেরে বলছিলেন তারা এসেছিলেন শুধুমাত্র কৌতূহলী হয়ে। কিন্তু তার বদলে ভালো নাটক দেখে গেলেন। আর আয়োজকদের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে ডিম মেলার আড়ালে প্রচারণার অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, ডিম দিবস উপলক্ষে আমরা সাধারণ মানুষকে একটি বার্তাই দিতে চেয়েছি, তা হলো ডিম একটি পুষ্টিকর খাদ্য, সকলেরই ডিম খাওয়া দরকার। তবে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে কেন ডাকা হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন্ন আয়ের মানুষেরা যেন কম দামে পরিবারের জন্য এক মাসের ডিম কিনে নিয়ে যেতে পারেন। সেজন্যই সর্বোচ্চ ৯০টি ডিম দেয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিশৃঙ্খলার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।