কুষ্টিয়া থেকে শরিফ মাহমুদ : ক্ষমতার অপবব্যহার, অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমান সম্পদের মালিক বনে গেছেন দুদকের মামলার আসামী পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা (৪৪)। তার এ বিপুল পরিমান সম্পদের হদিস মিলেছে কুষ্টিয়ায়। এ জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে চাকুরী কালীন সময় তিনি এসব অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার সম্পদের মধ্যে জমিসহ ৫ তলা একটি বাড়ি, মার্কেট ও পস্নট রয়েছে। যার মূল্য ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা। এছাড়া ক্রসফায়ারের ও ভয়ভীতি দেখিয়ে শহরের চৌড়হাস এলাকার এক ব্যক্তির আড়াই বিঘার ওপর পুকুর দখল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেন সুভাষ চন্দ্রসহ আরো কয়েকজন। এমনকি তার ৫ তলা বাড়ির কিছু অংশ জেলা পরিষদের জায়গার মধ্যে রয়েছে।যার মূল্য ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা।
সুভাষ চন্দ্র সাহা কুষ্টিয়ায় অতিরিক্তি পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন ২০১০ সালের প্রথম দিকে। জেলায় চাকুরি করেন প্রায় ৩ বছর। জেলায় অবস’ানকালিন সময় তৎকালিন কয়েকজন এসপির সাথেও তার নানা কারনে বিরোধ তৈরি হয়। এসব নিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাসে যে ৫তলা বাড়িটি ক্রয় করেছেন সেটির মালিক ছিলেন চৌড়হাস এলাকার সিকু নামের এক ব্যাক্তি। তার কাছ থেকে ১২ সালের দিকে জমিসহ বাড়িটি কিনে নেন সুভাষ চন্দ্র সাহা। পরে তার স্ত্রী রীনা সাহার নামে দলিল সম্পাদন করেন।
সিকুর সাথে কথা হলে জানান,‘ সুভাষ ভয়ভীতি দেখিয়ে জমিসহ বাড়িটি আমার কাছ থেকে কিনে নেন। এখনো আমি তার কাছে অনেক টাকা পাব। সে টাকা না দিয়ে উল্টো আমার বিরম্নদ্ধে গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে রেখেছে।
সিকু জানান, জমি বাড়িসহ সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৬কোটি টাকার সম্পদ আছে সুভাষের। সব তার স্ত্রী ও ভাইয়ের নামে দলিল করে রেখেছেন।
বুধবার সকালে চৌড়হাস এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির সামনে কয়েকজন ব্যাক্তি বসে আছেন চেয়ার পেতে। কথা বলে জানা গেল তাদের বাড়ি পাশেই জগতি এলাকায়। সুভাষের এক সময়কার পার্টনার আওয়ামী লীগ নেতা মোমিনুর রহমান মোমিজের ক্যাডার তিনি। নাম মজিম উদ্দিন। কথা হলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আপনারাতো সব জানেন আমি আর কি বলবো। পরে অবশ্য বলেন, এসপির এক আত্মীয় বাড়ি ও দোকানপাট দেখাশোনা করে। আর এসপি এখানে খুব একটা আসেন না।
দেখা গেছে, পাঁচ তলা বাড়িটিতে ১৪টি ফ্লাট রয়েছে। নিচে আছে ৮টি দোকান। এছাড়া বাড়ির পশ্চিমে আছে আরেকটি মার্কেট। সেখানেও ৬টি দোকান আছে। দোকানের পিছনে রয়েছে ৫কাঠার একটি পস্নট। প্রাচীর দিয়ে ঘোর জমিতে কলা গাছ ও অন্যান্য গাছ লাগানো আছে।
মার্কেটের একজন ভাড়াটিয়া জানান,‘ মাসে ১ হাজার ৫০০টাকা দিয়ে দোকানটি ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছি। এসব দোকান সুভাষ বাবুর। তিনিতো এখানে আসেন না। তার হয়ে স’ানীয় এক ব্যাক্তি ভাড়া আদায় করেন, ও সব দেখভাল করেন। ৪ থেকে ৫ বছর আগে এ বাড়ি ও দোকানগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এতদিন গোপন থাকলেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ওই পুলিশ সুপারের বিরম্নদ্ধে দুদকের মামলা দায়ের পর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।
ওই সুত্র জানায়, চৌড়হাস এলাকার সিকুসহ বেশ কয়েকজনের সাথে এসপির চরম দহরম মহরম ছিল। তাদের যোগসাজসে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক বনে যান। সিকুর সাথে অর্থ নিয়ে বিরোধ তৈরি হলে বাড়ি ও জায়গার দখল ঠিক রাখতে শহরের সে সময়কার প্রভাবশালী নেতা মোমিনুর রহমান মোমিজের সাথে খাতির গড়ে তোলেন। পরবর্তিতে মোমিজ যৌন সংক্রানত্ম ঘটনায় দল থেকে বহিস্কার হয়ে যান। এরপর কিছুদিন গা ঢাকা দিলেও সুভাষ থাকে প্রকাশ্যে আসতে সহযোগিতা করে। সুভাষের বাড়ির পিছনেই মোমিজের একটি ফ্যান তৈরির ফ্যাক্টরি আছে।
সুভাষের বাড়ির সামনে কয়েকটি চায়ের দোকান আছে। কথা হলে তারা জানান, মাগুরায় বাড়ি এক এসপি এসব জায়গার মালিক। তাকে আমরা কোনদিন দেখেনি। সিকুর কাছ থেকে এসব সম্পদ ক্রয় করেছে। এছাড়া জোর করেও অন্য মানুষের কিছূ সম্পদ তারা ভোগদখল করছে।
সে সময় এসব বিষয় নিয়ে জানাজানি হলে স’ানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মীর রেজাউল ইসলাম বাবুকে হয়রানী করেন সুভাষ চন্দ্র। বর্তমানে তিনি এলাকার পৌর কাউন্সিলর। কথা হলে বলেন,‘ সে মানুষকে অনেক হয়রানী করেছে। সে অবৈধভাবে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছে। যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন তার কঠোর শাসিত্ম হতে হবে।’
এসব সম্পত্তির মূল্য ৪ কোটি টাকা বলে স’ানীয়রা জানান।
এদিকে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভুত অর্থের সন্ধান পাওয়ার মঙ্গলবার দুদক তার বিরম্নদ্ধে মামলা করলে এই বাড়ি ও জমির বিষয়টি সবার নজরে আসে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা কিভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন, তা নিয়ে বিস্ময় ও ড়্গোভ প্রকাশ করেছেন স’ানীয়রা।
কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি রফিকুল ইসলাম টুকু বলেন, দুদক কর্তৃপড়্গ ওই পুলিশ সুপারের বিরম্নদ্ধে আয় বহির্ভুত সম্পদ থাকার অভিযোগে মামলা করেছে। তবে ওই সম্পদের বাইরে কুষ্টিয়ার এই বিপুল টাকার সম্পত্তির মত তার আর সম্পদ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে যাতে কোন দুর্নীতিবাজ ছাড়া না পেয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
জেলা পুলিশের ওসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,‘ সুভাষ চন্দ্র চাকুরি করার সময় ব্যাপক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন বলে অনেকেই জানেন। বিষয়টি গোপন নেই। এখনো তিনি কুষ্টিয়ার কয়েকজন বিতর্কিত লোকজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। তাদের ব্যাপারে আমাদের ফোন দেন। তবে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি আর যোগাযোগ রাখেন না। এছাড়া তার অবৈধ আয়ের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে কুষ্টিয়ার সম্পদ গোপন করার চেষ্টা করেন। রোজার ঈদের কয়েকদিন আগে জরম্নরী কুষ্টিয়ায় এসে এসব বাড়ি, জমি এক আওয়ামী লীগ নেতার নামে বায়না দেখানোর চেষ্টা করেন।
এসব বিষয়ে জানতে সুভাষ চন্দ্র সাহার ব্যাক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন দিলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
সুভাষের ব্যাচের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সুভাষ কখনো শানিত্মরক্ষী বাহিনীতেও কাজ করেননি। বরং তর তর করে দু’টি জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পেয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো সুভাষ কেন যশোরে এফডিআর করতে গেলেন?
সুভাষ চন্দ্র সাহা কুষ্টিয়ায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন ২০১০ সালের প্রথম দিকে। ওই জেলায় চাকরি করেন প্রায় ৩ বছর। এ অঞ্চলের অনেক কিছুই নিজের নখদর্পনে থাকায় যশোরে ওয়ান ব্যাংকেই নিজের গজ্জিত অর্থ রাখাকে নিরাপদ ভাবতে থাকেন তিনি। ১৯টি এফডিআরের মধ্যে ১২টিই যশোরে। ৬টি ঢাকার বংশালে আর অবশিষ্ট এফডিআরের অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এলিফ্যান্ট রোড শাখায়।
সময় সুযোগ বুঝে যশোর থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত ওই অর্থ তিনি ভারতে পাচারের উদ্দেশে রেখেছিলেন- এমন সন্দেহ খোদ সুভাষের ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তার।
দুর্নীতির মাধ্যমে ৮ কোটি টাকার বেশি উপার্জনের অভিযোগে ফরিদপুরের সদ্য সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) সুভাষ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী রীনা চৌধুরীর বিরম্নদ্ধে গত মঙ্গলবার রাজধানীর বংশাল থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যে কারণে ফরিদপুর থেকে প্রত্যাহার করে সুভাষকে সংযুক্ত করা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। বলা হয়েছে, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যনত্ম এ অবস’ানেই বহাল থাকবেন তিনি।
জানা যায়, মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার রাধানগর গ্রামের প্রয়াত সূর্য্য কানত্ম সাহা ও তরম্নলতা সাহা দম্পত্তির সনত্মান সুভাষ চন্দ্র সাহা।