পুলিশ বাহিনীর নীতিবিবর্জিত কিছু সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। প্রায় সময়ই তারা গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ধরনের অপেশাদার কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৬ বছরে ছয় শতাধিক পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গুরুদণ্ডের পাশাপাশি অনেকের লঘুদণ্ড হয়েছে। এছাড়া বিভাগীয় মামলা চলমান আছে শত শত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের অপরাধের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইপিজি নূর মোহাম্মদ বৃহস্পতিবার কেবিডিনিউজকে বলেন, প্রো-অ্যাকটিভ ও তদারকি ব্যবস্থা শক্ত না থাকায় পুলিশে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। ঘটনা ঘটার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে যতই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক না কেন, তাতে পুলিশের অপরাধ কমবে না।
তিনি বলেন, একদিনে কেউ অপরাধী হয়ে ওঠে না। কোন পুলিশ সদস্য কার সঙ্গে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, তার জীবনযাপন এসব বিষয়ে যথাযথ তদারকি নেই। আর তদারক কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। নূর মোহাম্মদ বলেন, একজন এসপি একদিনে ৮ কোটি টাকার মালিক হয়নি। আবার কোনো পুলিশ সিভিল ড্রেসে অভিযানে যাওয়ার আগে অবশ্যই তার সিনিয়র অফিসারদের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবেই পুলিশ সদস্যরা অপরাধে জড়াচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সাবেক এ আইজিপি বলেন, পুলিশে অপরাধ প্রবণতা থাকবে। মূল জায়গায় কাজ করে পুলিশ সদস্যদের অপরাধ প্রবণতা দূর করতে হবে। ভালো কাজের প্রশংসার পাশাপাশি অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পুলিশ অডিয়েন্স অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিললে এই অপরাধের জন্য তাকে ৭-৩০ দিনের মধ্যে চাকরিচ্যুত করা যাবে। আর ক্রিমিনাল অফেন্সের সঙ্গে যদি কোনো পুলিশ সদস্য জড়িয়ে পড়েন তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা হওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো জরুরি। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার সঠিক তদন্ত হয় না। এমন অভিযোগও এখন জনমনে বড় পারসেপশন।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, পুলিশের তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তাদের শৈথিল্য মনোভাব, নিয়োগ পদ্ধতির অস্বচ্ছতা, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত মোটিভেশন না হওয়া ও পুলিশের অপরাধের তদন্ত নিজেরা করায় উপযুক্ত শাস্তি হচ্ছে না। এ কারণে অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ। সর্বশেষ ২৬ অক্টোবর কক্সবাজারের টেকনাফে এক ব্যক্তিকে অপহরণের পর ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাতজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর ঠিক একদিন আগে মঙ্গলবার দুর্নীতির
মাধ্যমে ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা উপার্জনের অভিযোগে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) সুভাষ চন্দ্র সাহার বিরুদ্ধে রাজধানীর বংশাল থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে করে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যদিও গর্ব করার মতো পুলিশের অনেক সাফল্য রয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নানা অপরাধে জড়িত থাকার অপরাধে ৭৭ হাজার ৯২৬ জন পুলিশ সদস্যকে অর্থদণ্ড, তিরস্কার, বদলি বরখাস্ত বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৯৯ জনই কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পদের। বাকিরা পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর), সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ও তদূর্ধ্ব পদের। এর মধ্যে পরিদর্শক পদের ২৭২ জন এবং এএসপি ও তদূর্ধ্ব পদের ৫৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। জানা গেছে, শাস্তি পাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ৬২৪ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬০৮ জনই কনস্টেবল থেকে এসআই পদের। বাকি ১৫ জনের মধ্যে দু’জন পরিদর্শক ও ১৩ জন এএসপি ও তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা। তবে পারিবারিক অবস্থা ও চাকরির মেয়াদ বিবেচনায় নিয়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে ৭২ জন পুলিশকে। এর মধ্যে ৬৮ জনই কনস্টেবল থেকে এসআই পদের। বাকি চারজনের মধ্যে দু’জন পরিদশর্ক এবং দু’জন এএসপি ও তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা। এছাড়া অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় লঘুদণ্ড দেয়া হয় ৭১ হাজার ৭৭০ জন পুলিশ সদস্যকে। এর মধ্যে ৭১ হাজার ৪৮৪ জন কনস্টেবল থেকে এসআই পদের। বাকি ২৮৬ জনের মধ্যে ২৫৩ জন পরিদর্শক এবং ৩৩ জন এএসপি ও তদূর্ধ্ব পদের পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছে মোট ৪ হাজার ৩৩ জন পুলিশকে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৭ জন কনস্টেবল থেকে এএসআই পদের। বাকি ২৬ জনের মধ্যে ১৭ জন পুলিশ পরিদর্শক এবং নয়জন এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা। এদিকে এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুলিশের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হয়, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধে জড়ালে তার দায়ভার বাহিনী নেবে না। এটা সত্য। কিন্তু পুলিশের সাবেক কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও শৈথিল্য মনোভাবের কারণে পুলিশের মধ্যে এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধের লাগাম টানা যাচ্ছে না।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, নিয়োগ পদ্ধতির অস্বচ্ছতা, সঠিক সুপারভিশন ও মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সম্পর্কে সঠিক গোয়েন্দা তথ্য না থাকার সুযোগে কিছু সদস্য অপরাধে জড়াচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের যে স্পেশাল পুলিশ অডিয়েন্স রয়েছে সে অনুযায়ী অপরাধের বিচার হলে অবশ্যই অপরাধ কমবে।
এ সারির কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করেন, পুলিশে নিয়োগের সময় মোটা অংকের অর্থ লেনদেন হওয়ার অভিযোগ এখন অনেকে বিশ্বাস করেন। যার প্রভাব পড়ছে পুলিশ সদস্যদের ওপর। চাকরিতে নিয়োগের সময় দেয়া ঘুষের টাকা তুলতে গিয়ে এসব সদস্য এসব খারাপ পথ বেছে নেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে সিনিয়র অফিসারদের চাপে পড়েও অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। তাই শুধু দণ্ড দিয়ে পুলিশের অপরাধ প্রবণতা কমানো যাবে না। পুলিশ সদস্যদের অপরাধ প্রবণতা কার্যকরভাবে হ্রাস করতে হলে দণ্ডের পাশাপাশি নিয়মিত মোটিভেশন ও বিভাগীয় নজরদারি জোরদার করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়াউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে চলছে দেশের পুলিশ বাহিনী। কোন সদস্য কার সঙ্গে চলাফেরা করছেন, কোথায় অভিযানে যাচ্ছেন তার তথ্য সিনিয়র অফিসাররা জানতে পারছেন না। তিনি মনে করেন, পুলিশের প্রো-অ্যাকটিভ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এসব অপরাধমূলক কাজে জড়াচ্ছে পুলিশ। তিনি বলেন, পুলিশের অপরাধ কমাতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি নিয়মিত মোটিভেশন দিতে হবে।
পুলিশের বিরুদ্ধে উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মোখলেছুরর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান। পুলিশ ও জনতার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি হবে। পুলিশ সদস্য হিসেবে ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। বাহিনী তার অপরাধের দায়ভার নেবে না।
রাজশাহী সারদা পুলিশ একাডেমির পুলিশ সুপার (বেসিক ট্রেনিং) আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণে অনেক গুরুত্ব দিয়ে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিষয়গুলো শেখানো হচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মী স্কলারদের এনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে, যাতে পুলিশ সদস্যরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধে বলীয়ান হয়ে বাহিনীর ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখে। তারপরও কেন অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত অভিযোগ : সম্প্রতি ফকিরাপুলের জি-নেট টাওয়ারে অভিযানের নামে একটি রিক্রুন্টিং অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয় থেকে এক হাজার দু’শর বেশি পাসপোর্ট জব্দ করে কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির মতিঝিল ইউনিটের উপপরিদর্শক সুশান্ত কুমার রাহুত। শেষ পর্যন্ত ৪৫ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রায় ১১শ’ পাসপোর্ট ফেরত পান। বাকি ১০১টি পাসপোর্ট জব্দ তালিকায় দেখিয়ে ব্যবসায়ী অনুপমের ভাই প্রবীর বণিক ও তার দুই কর্মচারী মো. রিয়াদ হোসেন ও আশিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে সিআইডি। সিআইডির মতিঝিল ইউনিটের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আফরিদা রুবাই বলেন, এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিআইডির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়- এ ধরনের কোনো কাজ কাউকে করতে দেয়া হবে না। জি-নেট টাওয়ারের ঘটনাটি তিনি অবগত আছেন বলে জানান।
আরেক ঘটনায় ১৮ এপ্রিল কাফরুলের কচুক্ষেতের নিউ ওয়েভ ক্লাবে চাঁদাবাজির অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পূর্ব বিভাগের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ১১ পুলিশ সদস্যকে আটক করে মিলিটারি পুলিশ। পরে এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেন ডিএমপি। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অন্য আরেকটি ঘটনায় দেখা গেছে, খুলনা মেট্রোপলিটন (কেএমপি) পুলিশের উপকমিশনার আবদুল্লাহ আরেফের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগে ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার কারণ জানতে চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, উপকমিশনার আবদুল্লাহ আরেফের নির্দেশে তার দুই বডিগার্ড বর্তমান এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুন ও কনস্টেবল মাসুদুর রহমান অন্যের জমি দখল করে।
প্রসঙ্গত, পুলিশ অ্যাক্ট-১৮৬১ অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। এর একটি লঘুদণ্ড, অন্যটি গুরুদণ্ড। কাউকে বিনা অপরাধে শারীরিকভাবে নির্যাতন অথবা হত্যা করার শাস্তি গুরুদণ্ড। অর্থাৎ ফৌজদারি যে কোনো অপরাধ করলেই পুলিশ সদস্যদের গুরুদণ্ড দেয়ার কথা। কিন্তু গুরুতর অপরাধ করেও শাস্তি না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছেন সংশ্লিষ্টদের অনেককে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।