স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে অপরাধ বেড়েই চলেছে। অপরাধের সাথে জড়িত ডিবি’র সদস্যদের বিভাগীয় শাস্তি প্রদানের পরেও অপরাধ কমছে না। এতে করে সাধারণ লোকজন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।
উল্লেখ, রাজধানীর কাফরুলে ১টি ক্লাবে র্যাব পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে ফেরার সময় ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-ডিএমপি) ১১ সদস্য। সেই ঘটনার তদন্তে দোষী ডিবির সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন, পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন, এসআই জাহিদুল ইসলাম, এএসআই লুৎফর রহমানসহ ১১ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করা হয়। ঘটনাটি চলতি বছরের এপ্রিলের। ঐ সময় রাজধানীসহ সারাদেশে বেশ আলোচিত হয় ঘটনাটি। এমনকি ঐ ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেন সরকার ও পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ স্থানীয়রা। অপরাধে জড়ালে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলেও সেসময় হুঁশিয়ার করেন বাহিনীর সদস্যদের।
অপরদিকে গত বুধবার ভোরে কঙ্বাজারের টেকনাফে ১ ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে ফেরার সময় সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৭ সদস্য। টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে সেনাবাহিনীর তল্লাশির সময় ডিবি পুলিশের ১ উপ-পরিদর্শক (এসআই) গাড়ির গ্লাস ভেঙে পালিয়ে গেলে সেনা সদস্যরা গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ তাদের আটক করেন। টেকনাফে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় স্থাপিত সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের প্রধান অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পের মেজর নাজিম ৭ ডিবি পুলিশকে ১৭ লাখ টাকাসহ আটকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
এমনিতেই ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একশ্রেণীর প্রতারক ও ভুয়া ডিবি পুলিশ বিরুদ্ধে নিয়মিতই চাঁদাবাজি ও জিম্মি করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব ভুয়া প্রতারক ও ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ঘটনাও কম নয়। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডিবি পুলিশের কিছু সদস্য চাঁদাবাজি ও জিম্মি করে অর্থ আদায়ে নেমেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বাড়ি থেকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নেয়ার অভিযোগ এখন ওপেন সিক্রেট। কখনও কখনও কারো লাশ পাওয়া যায়, আবার কাউকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। কেউবা টাকা দিয়ে ছাড়া পায় বলেও অভিযোগ আছে।
ডিবি পুলিশ সেজে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গত মঙ্গলবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ পাশের গেটের সামনের রাস্তা থেকে ৫ জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পূর্ব বিভাগের ১টি দল। এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত গুলিভর্তি বিদেশি পিস্তল, মাইক্রোবাস, ডিবি পুলিশের পোশাক (ডিবি জ্যাকেট) টর্চ লাইট, ওয়্যারলেস সেট, লাঠি ও গামছা উদ্ধার করা হয় । এর ১ দিন আগে গত রোববার ঢাকার আশুলিয়ার বাইপাইল থেকে ভুয়া গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে প্রতারণার সময় ১ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। এ সময় তার কাছ থেকে পুলিশের ভুয়া পরিচয়পত্রও উদ্ধার করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর জয়পুরহাটে ৫ ভুয়া ডিবিকে আটক করে জনতা। তাদের ব্যবহৃত গাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেয় উত্তেজিতরা। ডিবি পুলিশের পরিচয়ে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া এলাকায় ১ ব্যক্তিকে অপহরণ করে ৩ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের পর পালানোর সময় ১টি প্রাইভেটকারসহ তাদের আটক করে গণধোলাই দেয়া হয়। ছিনতাইকারীদের ১টি প্রাইভেটকার পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা।
৯ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে ডিবি পরিচয়ে টাকা ছিনতাইকালে আটক করা হয়েছে ৪ ভুয়া ডিবি পুলিশকে। বগুড়ার শেরপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে পৌর শহর থেকে এ ৪ ব্যক্তিকে আটক করে। এ সময় ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত ১টি মাইক্রোবাস জব্দ করে পুলিশ।
চলতি বছরের ২০ মে ২০ পুলিশ-সামগ্রী ও অস্ত্রসহ ভুয়া ডিবির ১৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিএমপির ডিবি টিম। তাদের হেফাজত থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ২ রাউন্ড গুলি, ২টি খেলনা পিস্তল, ২টি চাপাতি, ৪টি ছুরি, ২টি ওয়াকিটকি, ৩টি ডিবি জ্যাকেট, ৪টি হ্যান্ডকাপ, ২টি বেতের লাঠি, ১টি কাঠের লাঠি, ১টি ব্যাগ, ২টি ডিবি স্টিকার, পুলিশের মনোগ্রাম সম্বলিত ১টি খালি আইডি কার্ডের কভার, তাদের ব্যবহৃত ২টি কার, ২টি মাইক্রোবাস ও ১টি আর্মি জ্যাকেটসহ অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
গত ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে পুলিশের গোয়েন্দা (পূর্ব) বিভাগ গ্রেফতার করে ১২ জন ভুয়া ডিবির সদস্যকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন জানিয়েছিলেন তারা স্বীকার করেছিল বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী গ্রাহকদের জিম্মি করে তাদের সবকিছু লুটে নিতো। তাদের কাছ থেকে ২টি পিস্তল, ৬ রাউন্ড গুলি ভর্তি ২টি ম্যাগাজিন, ১টি কাঠের লাঠি, ১টি প্লাস্টিকের তৈরি কালো রঙের ওয়াকিটকি, ২টি হাতকড়া, ২টি স্টেনলেস স্টিলের ধারালো চাকু, ১টি চওড়া স্কচটেপ, ১টি গামছা, ১টি ডিবি জ্যাকেট এবং ১টি সিলভার কালারের নোহা মাইক্রোবাসও উদ্ধার করা হয়েছিল। গত ১৬ জুন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভুয়া ডিবি চক্রের ৮ সদস্যকে আটক করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল, ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ও গাড়ি উদ্ধার করা হয়। গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরায় এক অভিযানে ৪ ভুয়া ডিবি পুলিশ আটক করেছিল র্যাব-১০। তাদের কাছ থেকে ১টি ৭.৬৫ মিমি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ২ রাউন্ড গুলি, ওয়াকিটকি সেট, হ্যান্ডকাফ, সিগন্যাল লাইট, নগদ ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫শ টাকা ও ১১টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। সেসময় র্যাব-১০ এর পরিচালক অতিরিক্ত ডিআইজি জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বিয়ষটি নিশ্চিত করেন।
গত ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রামে ডিবির ৮ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেন ১ দোকান কর্মচারী। অভিযোগে বলা হয়, মঈন উদ্দিন নামে ১ দোকান কর্মচারীকে তুলে নিয়ে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এমনকি তার মানিব্যাগে থাকা ৩ হাজার ৯০ টাকা ও ১টি মুঠোফোন কেড়ে নেন ঐ পুলিশ সদস্যরা। ডিবি পুলিশ জানায়, মঈন উদ্দিন জাল স্ট্যাম্পসহ গ্রেফতার হয়েছিল। মামলা থেকে বাঁচার জন্য সে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, আমাদের বাহিনীর কোনো সদস্য অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়ালে আমরা তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। ইতোপূর্বেও এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আর ভুয়া ডিবির নামে প্রতারকদের ধরতে আমাদের টিম সবসময় তৎপর। তিনি বলেন, ১টি বড় বাহিনীতে কিছু খারাপ মানসিকতার লোকও ঢুকে পড়ে। তবে আমরা তাদের চিহ্নিত করতেও কাজ করছি।