Kbdnews : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে স্বর্ণ পাচারকারীচক্রের সদস্যরা। পাচারকারী চক্রের সদস্যরা এখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেই নিরাপদ রুট মনে করছে। বিমান, সিভিল এভিয়েশন ও নিরাপত্তাকর্মীদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণের চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বিমানে চোরাচালানে জড়িত এয়ারহোস্টেস ও কর্মচারীরা জড়িত রয়েছে। মাঝে-মধ্যে দু-একটি চালান ধরা পড়লেও পাচার হয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগ স্বর্ণের চালান। কখনও বাহক (ক্যারিয়ার) ধরা পড়লেও মূল হোতাদের গ্রেফতার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সূত্র জানায়, স্বর্ণ পাচারকারীদের সঙ্গে বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকারী সিভিল এভিয়েশন, শুল্ক বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তাদের গোপন নির্দেশনা মোতাবেক বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে বড় বড় স্বর্ণের চালান বিমানবন্দর দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। পাচারকারী সিন্ডিকেটের প্রলোভনে পড়ে বিমানবালা, কেবিন ক্রু, প্রকৌশলী ও যাত্রীবেশী পাচারকারীরা স্বর্ণের চালান বহন করে আসছে। আর্মড পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অন্যতম। বিমানবন্দরের যাত্রী ও তাদের লাগেজ চেকিংয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তা চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। অনেক সন্দেহভাজনকে চেকিং ছাড়াই বের করে দেন তারা। সূত্র আরো জানায়, নিরাপদ ও অবাধ হিসেবে চোরাকারবারিরা ব্যবহার করছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে। ভারত, পাকিস্তান, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এদের নেটওয়ার্ক বিস্মৃত। তাদের সহযোগিতা করে বিমানবন্দর ও বিমানের দেখভালে নিয়োজিতরা। বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও ২-এ ৪ জন, কার্গোতে ৮ জনসহ ১২ জন শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। এ, বি ও সি এই ৩ শিফটে তারা কাজ করেন। এর মধ্যে ‘সি’ শিফট সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ। এই বিভাগের সহকারী কমিশনার ৩ জন, অতিরিক্ত কমিশনার ১ জনসহ অন্তত ৬ জন শুল্ক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে। এদের সহযোগিতা করে সিভিল এভিয়েশন ও গোয়েন্দা বিভাগের আরও কিছু কর্মকর্তা। পাশাপাশি বিভিন্ন উড়োজাহাজের পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার, কেবিন ক্রুরাও চোরাকারবারিদের সহযোগিতা করে থাকে। বিমানবন্দরের ট্রানজিট এরিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আন্তর্জাতিক এরিয়া হিসেবেও তা পরিচিত। স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য এটিই এখন ব্যবহার করছে চোরাকারবারিরা। কোনো ফ্লাইট যাত্রা বিরতি দিলে তারা স্বর্ণের ব্যাগ, লাগেজ নিয়ে ট্রানজিট এরিয়ায় অপেক্ষা করে। একসময় সুযোগ বুঝে তা আগে থেকেই নির্ধারিত ও নিজস্ব লোকজনের হাতে ধরিয়ে দিয়েই সটকে পড়ে। বাকি কাজ (টার্মিনাল পার করা) করে দেয় শুল্ক ও গোয়েন্দা শাখা, সিভিল এভিয়েশনের অসাধু কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এছাড়া উড়োজাহাজ ল্যান্ড করার পর তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার জন্য নিয়ে আসা হয় কার্গো এরিয়ার হ্যাঙ্গার গেটে। আর তখনই উড়োজাহাজ থেকে স্বর্ণ নামানোর কাজটি সেরে দেয় সেখানকার কর্মচারীরা। পাচারকৃত স্বর্ণ কখনও রাখা হয় বোর্ডিং ব্রিজের পাশে ওয়াশরুমে। সেখান থেকে দেয়া হয় গ্রীন অথবা রেড সিগন্যাল। এরপর সময় ও সুযোগ বুঝে বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় তা টার্মিনালের বাইরে নিয়ে আসা হয়। কাজ সফল হলে সংশ্লিষ্টদের দেয়া হয় চালানের বড় একটি অংশ। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, যাত্রীরা উড়োজাহাজ থেকে নেমে ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’ পার হয়ে আসেন এপ্রোন এরিয়ায়। সেখান থেকে ইমিগ্রেশনের কাজ সম্পন্ন করে বোর্ডিং এরিয়া পার হয়ে আসেন কনভেয়ার বেল্টে। বেল্ট এরিয়াতে হলেই যাত্রী ও তাদের লাগেজ স্ক্যানিং করা হয়। যাত্রী ছাড়াও উড়োজাহাজ সংশ্লিষ্ট পাইলট, প্রকৌশলী, কেবিন ক্রু, কর্মচারীদের স্ক্যানারের সম্মুখীন হওয়া বাধ্যতামূলক।
অভিযোগ রয়েছে, শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা অনেক সময় স্ক্যানিং মেশিনে যাত্রীদের ব্যাগ, লাগেজ ও শরীর স্ক্যানিং করতে দেন না। শুধু তাই নয় নিরাপত্তা কর্মীরা কারও লাগেজ, ব্যাগ ও শরীর চেক করতে চাইলে তারা তা ‘চেক ব্যাক’ (সার্চ না করেই ফেরত) করে দেন। আর এভাবেই চোরাকারবারিরা সহজেই স্বর্ণ বহন করে কাস্টমসের ঝামেলা এড়িয়ে গ্রীন চ্যানেল, কনফোর্স হল পার হয়ে যান। একসময় বিমানবন্দরের ক্যানোপি অতিক্রম করে নির্বিঘ্নে টার্মিনালের বাইরে চলে আসেন। একই সঙ্গে বিমানের কেবিন ক্রুরা শরীরের স্পর্শকাতর ও গোপন স্থানসহ জুতা, মোজার ভেতরে সহজেই বহন করে নিয়ে আসে স্বর্ণসহ বৈদেশিক মুদ্রা।
অপর একটি সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালান নির্বিঘ্ন রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে পাচারকারীরা। এসব নিত্যনতুন কৌশলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে স্বর্ণ চালান ধরতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে। অভিনব কায়দায় কখনো চায়ের ফ্লাস্ক, বিদেশি বিস্কুটের প্যাকেট, জুসের প্যাকেট, জুতার ভেতর, প্যান্টের বেল্টের ভেতর, নারীর চুলের খোঁপায়, দেহের গোপনীয় জায়গায়, ল্যাপটপ এমনকি ওয়াটার পাম্পের ভেতরে করে স্বর্ণের বার পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া কিছু স্বর্ণের বার দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়লেও সীমান্তপথে বড় অংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ অন্যান্য দেশে চলে যায়। লাগেজ কেটে বিশেষ পার্ট বানিয়ে, জুতার ভেতরে কিংবা পায়ুপথে স্বর্ণের বার ঢুকিয়ে পাচার করার পুরনো কাহিনী এখন আর পাত্তা পায় না। এয়ারপোর্টে কাস্টমস গেটের স্ক্যানার মেশিনেও যেমন স্বর্ণের অবস্থান চিহ্নিত হয় তেমনি পাচারকারীর চলাফেরার সন্দেহেও স্বর্ণ পাচারকারীরা মুহূর্তেই ধরা পড়ে। ফলে চোরাচালানকারী ইদানীং এমন সব কৌশল ব্যবহার করছেন যা ধারণা করাও কঠিন। বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গরুর পেটের ভেতর স্বর্ণের বার ঢুকিয়েও ভারতে পাচারের ঘটনা ঘটছে।