স্টাফ রিপোর্টার : ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা বিস্ফোরক আইনে মামলায় ফ্রিডম পার্টির ১১ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। একই ঘটনায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা অপর মামলায় এই ১১ সদস্যকে ২০ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। ২ মামলাই ফ্রিডম পার্টির সদস্য হুমায়ুন কবিরকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
গত রোববার ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এবং পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের অস্থায়ী ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির এ রায় ঘোষণা করেন। বিস্ফোরক আইনে মামলায় প্রত্যেক আসামিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৬ মাসের কারাদন্ড এবং হত্যাচেষ্টা মামলায় প্রত্যেককে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন আদালত।
দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন-গোলাম সারোয়ার ওরফে মামুন, জজ, ফ্রিডম সোহেল, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ, গাজী ইমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল, মিজানুর রহমান, হুমাউন কবির (পলাতক), মো. শাজাহান বালু (পলাতক), লেফটেনেন্ট কর্নেল আবদুর রশীদ (পলাতক), জাফর ও আহম্মদ ওরফে মানিক (পলাতক)।
রায় ঘোষণার পর ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ফ্রিডম পার্টির ১১ সদস্যকে দন্ডবিধি ১২০(খ) এবং ৩০৭ ধারায় ১০ বছরকরে ২ ধারায় মোট ২০ বছর করে কারাদন্ড দেন আদালত। কারাদ-ের পাশাপাশি আসামিদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে ৬ মাস করে ১ বছরের কারাদন্ড দেন আদালত। এছাড়া একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা অন্য মামলায় ১১ আসামির যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।
অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান বলেন, ২ মামলার রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। এর বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে মামলার রায়ের জন্য ২৯ অক্টোবর দিন ধার্য করেন আদালত।
দ-িতরা হচ্ছে-খন্দকার আবদুর রশীদ, মো. মিজানুর রহমান, মো. শাজাহান বালু, গাজী ঈমাম হোসেন, জর্জ মিয়া, গোলাম সারোয়ার মামুন, মো. সোহেল ওরফে ফ্রিডম সোহেল, গোলাম সারোয়ার মামুন, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ, মো. হুমায়ুন কবির হুমায়ুন ও খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল। এছাড়া হুমায়ুন কবির নামে ১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। রায়ে দ-িত ১১ জনকে ২০ বছরের কারাদন্ড ও প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু তার প্রতিক্রিয়ায় রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ধারাবাহিকতায়ই এ হামলা করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল। এই রায়ের মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে। আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট।
তিনি বলেন, পৃথক ২টি ধারায় আসামিদের ১০ বছর করে দন্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ১০ বছর করে এ শাস্তি কার্যকর হবে। যারা কারাগারে আছে, তাদের কারাভোগের মেয়াদ এই শাস্তি থেকে বাদ যাবে।
এ মামলায় আটক আসামিদের গতকাল রোববার আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা ৪ আসামি গাজী ঈমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল, মো. মিজানুর রহমান ও মো. শাজাহান বালুও আদালতে হাজির ছিলেন। জামিনে থাকা দন্ডিতদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে গুলি ও বোমা ছোঁড়া হয়। শেখ হাসিনা তখন বাড়িতেই ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নেতৃত্বে গঠিত দল ফ্রিডম পার্টির নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ঐ হামলা চালিয়েছিল বলে পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে। ঐ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু ভবনের (বর্তমানে জাদুঘর) নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম মামলাটি রুজু করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের ১টি দল অতর্কিত গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে এবং হামলাকারীরা ‘কর্নেল ফারুক-রশিদ জিন্দাবাদ’ বলে শ্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়। এইচ এম এরশাদের আমলে ঐ মামলা হওয়ার পর তদন্ত করে ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি সাইফুল ইসলাম হেলাল সাংবাদিকদের জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর ঐ বছর ২ সেপ্টেম্বর মামলাটি পুনরায় তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মো. খালেক-উজ্জামান আদালতে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে ২টি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে ফ্রিডম পার্টির নেতা ও বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, আবদুর রশীদ ও বজলুল হুদাসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে মামলাটি স্থবির থাকে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের বিপুল বিজয়ে সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ৫ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। ঐ বছরের ২৭ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
পরে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলেও সাক্ষী হাজিরসহ নানা কারণে মামলাটি কার্যক্রমে গতি পায়নি। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে মামলার নথি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। ৩ জন বিচারকের হাত ঘুরে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির হত্যা চেষ্টা মামলার বিচার শেষ করে রায় দেন।
মামলার অভিযোগপত্রে বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ও মেজর বজলুল হুদার নাম থাকলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ ২ মামলা থেকে তাদের বাদ দেয়া হয়। রেজাউল ইসলাম খান ফারুক ও লিয়াকত হোসেন কালা নামের ২ আসামির মৃত্যু হওয়ায় তাদের নামও মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়। বাকি আসামিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি খন্দকার আবদুর রশীদ, আসামি মো. জাফর আহম্মদ ও হুমায়ুন কবির ওরফে হুমায়ুন পলাতক রয়েছেন।
মামলার আসামি মিজানুর রহমান, শাজাহান বালু, গাজী ইমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল ও হুমায়ুন কবির ওরফে কবীর জামিনে ছিলেন। আর গোলাম সারোয়ার ওরফে মামুন, ফ্রিডম সোহেল, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ ও জর্জ মিয়া ছিলেন কারাগারে। আসামিদের মধ্যে সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়ে ফ্রিডম পার্টির কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ২০ মার্চ আটলান্টা থেকে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
এ মামলায় বিচার কাজ চলে মোট ৬৬ কার্যদিবস। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। আসামিপক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষ্য দেয়নি। আসামিপক্ষে আইনজীবী এ এস এম গোলাম ফাত্তাহ ও এম এম ফারুক এ মামলায় শুনানি করেন।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে বিভিন্ন সময় ১৯ বার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ঐ ঘটনায় ২৪ নেতাকর্মী নিহত ও শত শত নেতাকর্মী আহত হয়। আলোচিত ও ইতিহাসের বর্বরোচিত ও ঘটনায় দায়েরকৃত মামলারও বিচার এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে।