আমিরুল ইসলাম অমর : লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। বর্তমানে আমাদের সমাজে ধর্ষণ একটি আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনার সংবাদে আঁতকে উঠতে হচ্ছে। শিশু, শিক্ষার্থী, কিশোরী, বয়স্ক নারী প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান থাকলেও বিচারহীনতার কারণে ধর্ষকরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অনেকেই মনে করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নির্যাতিতা নারীদের প্রতি সমাজের সংবদেনশীলতার ঘাটতি, নিয়ন্ত্রণহীন ইন্টারনেট, নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি দায়ী। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। এসব ঘটনার বিচার পেতেও নির্যাতিতা নারীকে পদে পদে হয়রানি আর অবমাননার শিকার হতে হয়। আর এসব কারণেই দিন দিন ধর্ষণ বাড়ছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, টেলিভিশনের অশ্লীল ছবি, মোবাইল ফোনে আপলোড করা বস্নু ফিল্ম দেখে দেখে ধর্ষকরা মেয়ে শিশু ও নারীদের ধর্ষণ করতে প্রলুব্ধ হয়। তাছাড়া আইনের ফাঁকফোঁকর গলিয়েও এরা মুক্তি পেয়ে যায়। ধর্ষণের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তি না পাওয়ায়ও ধর্ষকরা ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাচ্ছে।
দেখা যায়, প্রতিদিনই আমাদের দেশের কোথাও না কোথাও মেয়ে শিশু, কিশোরী ও যুবতী নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা বা হত্যার চেষ্টা চলছে। যেসব ধর্ষিতা কিশোরী বা যুবতী নারী প্রাণে বেঁচে যাচ্ছে তাদের জীবনে নেমে আসছে অমানিশা। পরিবার ও সমাজ তাদের ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। অথচ তাদের কোনোই অপরাধ নেই। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতারা আত্মগ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অনেক মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার পর লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টা পিতা-মাতাকেও জানাতে ভয় পায়। ফলে ধর্ষকরা পার পেয়ে গিয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে বেড়ায় এবং তারা মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণ করতে প্রলুব্ধ হয়।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রায়ই ধর্ষণের ঘটনার নানা পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে। তবে এই পরিসংখ্যানই চূড়ান্ত নয়। এর বাইরে বহু ঘটনা নজরে আসে না। ফলে আড়ালের ঘটনাগুলো আড়ালেই থেকে যায়। ধর্ষিতা এবং প্রতিপক্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থানের তারতম্যের কারণে এসব ঘটনা সামনে আসে না। এমনকি মামলা পর্যন্তও গড়ায় না। আবার মামলা হলেও নানা কারণে পার পেয়ে যায় ধর্ষকরা। আবার অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও মান-সম্মানের ভয়ে নিজে থেকেই সামনে আসছে না। ধর্ষিতার পরিবারও বিষয়টি চেপে যাচ্ছে। এভাবে প্রতিদিনই চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক ঘটনা। দেখা গেছে, গণমাধ্যম সরব হলেই কেবল ঘটনাগুলো সামনে আসছে। তবে যতটুকু গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় সে চিত্রও ভয়াবহ। গত সাড়ে ৫ বছরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সারাদেশে ধর্ষণের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। তাদের দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সাড়ে ৫ বছরে দেশে ৫ হাজার ২৪৮টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) বলছে, গত ৬ মাসে ১৪১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে আর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৩ নারী। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে শুধুমাত্র শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৬ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮ শিশুকে আর ৩ জন শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে আরও ২৮ শিশু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিসংখ্যান গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদনির্ভর। এর বাইরের চিত্র আরও ভয়াবহ। আসকের দেয়া তথ্যানুযায়ী, সাড়ে ৫ বছরে গড়ে দিনে প্রায় ৩টি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে ৩৭৩ নারী ও শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ৫৬ জন। সংস্থাটির দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ১১৪৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৯৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১৪ জন ধর্ষণের অপমান সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৩ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৯৮ জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৮৭ জন আর একই কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৪ জন। ২০১৪ সালে ৭০৭ জন ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৬৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১৩ নারী-শিশু ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৫ সালে ধর্ষিত হয়েছে ৮৪৬ জন, খুন করা হয়েছে ৬০ ধর্ষিতাকে এবং আরও ২ জন আত্মহত্যা করেছে। ২০১৬ সালে ৭২৪ নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৩৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং একই কারণে আত্মহত্যা করেছে ৮ জন।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সাড়ে ৫ বছরে ১৭১৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৮৬, ২০১৩ সালে ১৭০, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন শিশু ধর্ষিত হয়েছে। অতীতে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু এই নৃশংসতার শিকার হয়েছে। গত বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৬ জন শিশু। আর চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৬ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮ শিশুকে আর ৩ জন শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে আরও ২৮ শিশু।
তবে এই পরিসংখ্যান যত ভয়াবহ-ই হোক এটি বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার খন্ডিত চিত্র মাত্র। সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহকারীরা বলছে, এ পরিসংখ্যান মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদনির্ভর। এছাড়া কেউ কেউ তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও তথ্য সংগ্রহ করেন। তবে একটি বড় অংশই থেকে যায় খবরের আড়ালে।
এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একই ব্যক্তি একাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে। সামনে এসেছে মাত্র একটি। এরপর তদন্তে বা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে একাধিক ধর্ষণের ঘটনা। তবে পরিসংখ্যানে একটি ঘটনাই যোগ হয়েছে। আবার অনেক ঘটনা প্রকাশই পায় না। ফলে সেগুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ধর্ষণকারী সমাজের প্রভাবশালী হওয়ায় ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে আপোস-মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে। অনেক ঘটনায় মামলা হচ্ছে না বা সংশ্লিষ্ট থানা মামলা নিচ্ছে না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংগ্রহকারী কর্মকর্তা ঝর্ণা খানম বলেন, তারা ৯টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য সংগ্রহ করেন। এছাড়া স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও কিছু তথ্য পান। তবে তা খুবই সামান্য। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী বলেন, বিচারহীনতার কারণেই ধর্ষণের বিষয়গুলা আরও বেশি হচ্ছে। বারবার প্রমাণ করতে গিয়ে ভিকটিম দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হয়। থানায় মামলা নিতে বা আসামি পক্ষের আইনজীবী যেভাবে প্রশ্ন করে তখন কিন্তু সে আরেকবার ধর্ষণের শিকার হয়। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে, বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে কিছুটা সময় নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে মামলা শেষ হতে ১০ বছর ২০ বছরও লেগে যাচ্ছে। ধর্ষণের বিচারহীনতার কারণ হিসেবে ভিকটিম এবং নারী অধিকার কর্মীরা পুলিশের গাফিলতির প্রসঙ্গটি বারবারই সামনে আনেন। থানায় মামলা দায়ের থেকে শুরু করে ভিকটিমের সঙ্গে আচরণ, তদন্ত এবং অপরাধীকে গ্রেফতার সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে।
ওসিসির সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম বলেন, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতার কারণে এবং ধর্ষণের ঘটনায় বিচার না হওয়ায় শিশু ধর্ষণের হার বেড়েছে। অপরাধীরা ধরেই নিয়েছে এর কোনো বিচার হয় না। আর যেখানে অপরাধের কোনো বিচার নেই, সেখানে অপরাধ বাড়বেই। শিশুরা ধর্ষণের বড় শিকার। কারণ তারা কিছুই বলতে পারে না, অসহায় থাকে ধর্ষণের সময়। বিলকিস বেগম আরও বলেন, মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এটা শুনতে কোনো অভিভাবকেরই ভালো লাগে না, একইসঙ্গে সমাজ এখনও ভিকটিমদের ব্যাপারে সংবেদনশীল নয়। আত্মীয়-স্বজনসহ পুরো সমাজ তার দিকেই আঙুল তুলবে, এ ভয়েই অনেক পরিবার ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করে না। এর ফলে অপরাধীদের কথাও প্রকাশ হয় না। আবার অনেক সময় মামলা করলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীদের ঠিকমতো বিচার হয় না।
বিএসএএফ’র প্রোগ্রাম অফিসার আজমি আক্তার বলেন, তথ্যগুলো মূলত প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগ্রহ হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। বিশেষ করে নিকটাত্মীদের দ্বারা যখন এমন ঘটনার শিকার হয় তখন অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। এছাড়া অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়ে আইনি সহযোগিতাও পান না।
ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ডাক্তার বিলকিস বেগম বলেন, শারীরিক পরীক্ষা যথাসময়ে না হলে ধর্ষণ প্রমাণ ও বিচার পাওয়া কঠিন। তিনি বলেন, আইনি লড়াইয়ের জন্য এই যে সার্টিফিকেটটা খুবই দরকার, এই সার্টিফিকেট না হলে কোনো বিচারই হবে না। ওরা আসতেই দেরি করে ফেলে অনেক সময়। ফাইন্ডিংস আমরা ঠিকমতো পাই না। ঘটনা ওরা স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, সময়টা কিল করে ফেলে। লিডাররা বসে ৭ দিন ১৫ দিন পার করে ফেলে আমরা ফাইন্ডিংস পাই না।