বি এম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: ভারতের কয়েকটি প্রদেশে গরু জবাই বন্ধ থাকলেও ট্যানারি বন্ধ হয়নি। আর সেকারণে এবারের চামড়া ভারতে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের সীমান- দিয়ে তাই ভারতীয় ব্লাকাররা চামড়া পাচারে এবার আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের চোরাচালানীরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মোকামে ব্লাকে চামড়া নিতে অর্থলগ্নি করছে। খুলনাঞ্চলের সীমান- তথা অবৈধ ঘাটগুলো দিয়ে প্রতি বছর চামড়া পাচার হয়। সাতক্ষীরার সীমান-গুলো দিয়ে গরু আসা বন্ধ হলেও ভারতের অসাধু ব্যবসায়ীরা গরু দেয়ার বদলে চামড়া নিতে এখন মরিয়া। কলোবাজারি চামড়া ব্যবসায়ীরা তাই নড়েচড়ে বসেছে। এদিকে ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতা, লবনের মূল্য বৃদ্ধি, পুজি সংকট, ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির টাকা সময় মত না পাওয়া, রাজনৈতিক অসি’রতাসহ নানা কারণে সুযোগ বুঝে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের চামড়া বাজারের নিয়ন্ত্রন নিতে কোটি কোটি টাকার পুজি লগ্নি করেছে। এ ক্ষেত্রে অনেক পুজিপতিরা হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা খুলনাঞ্চলে বিনিয়োগ করছে। এ কারনে এবারের কোরবানির চামড়া খুলনাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও টেনারি মালিকদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতীয় ফড়িয়াদের চক্রান- এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্নসহ নানা কারণে খুলনাঞ্চলের দুইশতাধিক চামড়া প্রতিষ্ঠান এখন মাত্র ১০-১২টিতে নেমে এসেছে। সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে সীমানে- নজরদারি ও গোয়েন্দা সংস’ার মাধ্যমে কালোবাজরিদের চিহ্নিত করে ব্যবস’া নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে লবনের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। গতকাল ভারতের চেন্নাই ও কানপুর থেকে ঘুরে আসা চামড়া ব্যবসায়ী মো: আজম বলেন, চামড়া কেনা বেচা আমাদের পৈত্রিক ব্যবসা। চামড়া রপ্তানির জন্য চেন্নাই ও কানপুর মোকাম ঘুরে জানতে পেরেছি এবারও ভারতের অসাধু ব্যবসায়ীরা চোরাই পথে চামড়া পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একশ্রেনীর প্রভাবশালী দালাল চক্র রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে এদেশ থেকে চামড়া পাচারে বিশেষ সহায়তা দিচ্ছে। এই চক্রকে প্রতিরোধ না করা গেলে আমাদের ব্যবসা চরমভাবে ভূলন্ঠিত হবে।
সূত্রমতে, গত অর্ধযুগে চামড়া পাচার বেড়েই চলেছে। আসছে কোরবানী। অথচ খুলনাঞ্চলের চামড়া ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি নেই। মূলধনের অভাবে ব্যবসায়ীরা সাধারণত বাকিতে বেচা কেনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকার আড়ৎ থেকে বকেয়া টাকা আদায়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হাপিয়ে ওঠে। প্রায় শত বছর পূর্বে গড়ে ওঠা খুলনা শের-এ-বাংলা রোডের চামড়া পট্টিতে কাঁচা চামড়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল প্রায় দুই শতাধিক। এর মধ্যে এখন কোনও রকমে টিকে আছে মাত্র ২/৩টি প্রতিষ্ঠান। আর দুই শতাধিক ব্যবসায়ীর মধ্যে এখন আছে মাত্র ১২ জন। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় পুঁজি খাটিয়েও ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে দীর্ঘদিনের বকেয়া আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে চাহিদানুযায়ী ব্যাংক ঋণও পাচ্ছেন না তারা। এতে পুঁজি সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। আবার ব্যবসার জন্য দোকান পাওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৬০ টাকা এবং খাসির চামড়া ২০ টাকা দরে চলছে। ব্যবসায়ীদের মতে, কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ দেয়া হয় চলতি হিসাবের বিপরীতে। তার পরও ব্যাংকে সম্পত্তির দলিল জমা দিতে হয়। চামড়া বিক্রির টাকা ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া পড়ে আছে অন-ত ৮ কোটি টাকা। ব্যবসা ভালো নয় বলে তারাও টাকা দিচ্ছে না। তাই এ অবস’ায় চরম দুশ্চিন-ায় পড়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। ঈদের জন্য এখনও চামড়ার প্রতি ফুট মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। খুলনার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতি বছর কোরবানীর ঈদের সময় পশুর চামড়া কেনার জন্য কোন ঋনের সুবিধা পায় না। প্রতি বছরই পুজি সংকট দেখা দেয়। এবার এ সংকট তীব্র আকারে ধারন করেছে। আর এ সুযোগে পুজি বিনিয়োগ করে ফেলেছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। কারন ভারতের বাজারে প্রায় দ্বিগুন দামে বাংলাদেশের চামড়া বিক্রি হয়। তাই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চোরাকারবারীরাও চামড়া ব্যবসায় পুজি বিনিয়োগ করেন দ্বিগুন লাভের আশায়। সীমান- এলাকাগুলোর চামড়া ক্রয়ের জন্য ভারতীয় টাকায় সয়লাব হয়ে গেছে সমগ্র খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট। উদ্দেশ্য চামড়া ভারতে নেয়া। আর এ জন্য প্রানি-ক অবস’া থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীরাও অগ্রিম টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে। ফলে কোরবানির চামড়ার বাজার খুলনাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও টেনারি মালিকদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, ভারতের টেনারি শিল্প মালিকরা সিংহভাগ চামড়া অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে। খুলনাঞ্চলের চামড়া ব্যবসায়ীরা এবার ঝুকে পড়েছে কালোটাকার প্রতি। গত বছরের তুলনায় এবার দশ ভাগ চামড়ার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আশায় বুক বাধলেও অন্যদিকে লবনের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দারুনভাবে হতাশ হয়ে পড়েছে।
সূত্রমতে, দেশে- বিদেশে চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অমিত সম্ভাবনা রয়েছে শিল্পটির। চামড়া শিল্পেরসাথে জড়িত লাখ লাখ পরিবার। পরিকল্পিতভাবে চামড়া ক্রয় বিপনন প্রক্রিয়াজাতকরন ও রপ্তানির প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার অভিমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের । ঈদুল আযাহ উপলক্ষেই প্রতি বছর চামড়ার সবচেয়ে বড় যোগান সৃষ্টি হয়। এই মহেন্দ্রক্ষনকে সামনে রেখেই প্রতি বছর কালোবাজারীরা তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের ফাঁদ পাতে। আর সেই ফাদেই পা দিয়ে থাকেন প্রানি-ক চামড়া ব্যবসায়ীরা। দেশীয় এই সম্পদকে দেশের কাজে লাগানোর জন্য সুশীল সমাজ দাবি জানিয়েছেন।
অপরদিকে, ঈদের আগেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। এক বস-া লবণ এখন কিনতে হচ্ছে ১২৫০ টাকা দিয়ে। সব মিলিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত এই চামড়া শিল্পের উন্নয়নে ব্যবসায়ীদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের রাজম্ব কমবে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের।
বি এম রাকিব হাসান,
খুলনা ব্যুরো
১৮-০৮-১৭