কোরবানির ঈদ ঘিরে জাল টাকা তৈরিতে দেশি-বিদেশি ২১টি চক্র জড়িত ১২ জন কারিগর, বাকিরা কেউ তত্ত্বাবধায়ক, কেউ সমন্বয়কারী আবার কেউ পরিবেশক
স্টাফরিপোটার: কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে দেশি-বিদেশি জাল টাকার নোট তৈরির প্রতারকচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। প্রতারক চক্রের সদস্যরা ১শ, ৫শ ও ১ হাজার টাকার জাল নোট তৈরিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গোপনে কারখানা গড়ে তুলছে বলে জানা গেছে। তাদের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে কোরবানির পশুহাট। তবে এবার যেন প্রতারকচক্র জাল টাকার নোট বাজারে ছাড়তে না পারে, সেজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগে থেকেই নজরদারি শুরু করেছে। প্রতারকদের ধরতে এরই মধ্যে অভিযানে নেমেছে তারা। একই সঙ্গে এখন টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার জাল নোট দেশে ঢুকছে। রাজধানীতেও বিভিন্ন এলাকায় গোপনে তৈরি হচ্ছে জাল টাকা। দেশের জালিয়াতদের সাথে পাকিস্তান, আফ্রিকার ও ভারতসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকরাও এই জালিয়াতিতে জড়িত।
আসন্ন ঈদুল আযহায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় বসছে পশুহাট। তবে প্রতারকচক্র যাতে জাল টাকা বাজারে ছাড়তে না পারে সেজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগে থেকেই নজরদারি শুরু করেছে। আর প্রতারকদের ধরতে ইতোমধ্যে অভিযানেও নেমেছে গোয়েন্দারা।
সূত্র জানায়, পুলিশ জাল টাকার ২১টি চক্রের সন্ধান পেলেও রাজধানীতে আরো বেশ কিছু চক্র রয়েছে বলে ধারণা করছে। তবে ২১টি চক্রের মধ্যে জাল নোটের কারিগর রয়েছে ১২ জন। আর বাকিরা কেউ তত্ত্বাবধায়ক, কেউ সমন্বয়কারী আবার কেউ পরিবেশক। মূলত পরিবেশকের মাধ্যমেই গ্রামগঞ্জে জাল নোট ছড়িয়ে পড়ছে।
সেখানে তারা জাল নোট বিক্রি করে ৬০ ভাগ কমিশনে। অর্থাৎ কারখানা থেকে ১শ টাকার একটি জাল নোট বিক্রি করা হয় ৪০ টাকায়, ৫শ টাকার নোট ২শ টাকায় ও ১ হাজার টাকার জাল নোট বিক্রি হয় ৩শ টাকায়। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমেই এসব জাল নোট তৈরি হচ্ছে। আর নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচরসহ রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতেই প্রতারকরা কাজ করে থাকে। এসব স্থান থেকেই সারাদেশে জাল নোট বণ্টন হয়। ঐ চক্রের একজন গডফাদার থাকে। নামও ব্যবহার করে একাধিক। ঐ কারণে তাদের অবস্থান বা পরিচয় নিশ্চিত হতে বেশ বেগ পেতে হয়।
বর্তমানে রাজধানীতে জাল টাকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ইব্রাহিম নামে একজন। তাছাড়া জাল টাকা তৈরির মূল হোতা জাকির মাস্টার ও কাওছার মিয়া দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে আছে। তবে তারা আত্মগোপনে থাকলেও সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়। কল্যাণপুরের নার্গিস আক্তার, শারমিন আক্তার, সোহেল, সাগর, রোজিনাসহ ১০৯ পুরুষ ও নারী জাল টাকা তৈরি এবং বণ্টনে সার্বক্ষণিক কাজ করছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই এদেশে ঈদে ২০/৩০টি চক্র জাল টাকা বেচাকেনা করছে। তার মধ্যে মিরপুরের জাকির গ্রুপ, খিলগাঁও, সবুজবাগ ও বাসাবো এলাকায় লোকমান গ্রুপ, পুরনো ঢাকায় ইমন গ্রুপ, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় কাওসার গ্রুপ।
তাছাড়া জাল টাকা তৈরির অন্যতম গুরু নুরুজ্জামান, সগীর আলী, মোস্তফা চিশতী এবং মাহবুবসহ অন্যরা জাল টাকার রমরমা ব্যবসা করে আসছে। তাদের আবার শাখা-প্রশাখাও রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও আবার আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ঐ কারণে তাদের দৌরাত্ম্য রোধ করা যাচ্ছে না।
জাল টাকা ব্যবসায়ী চক্রের প্রত্যেকেই পেশাদার। তারা একদিকে জাল টাকার নোট তৈরি করে, অন্যদিকে জাল টাকার ব্যবসাও করে। ওসব চক্রের অনেক সদস্যই এই ব্যবসার সঙ্গে অনেক বছর ধরে জড়িত। তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি করে। ধরা পড়ার ভয়ে তারা এক বাসায় বেশি দিন থাকে না। কয়েক মাস পর পর তারা বাসা বদলে চলে যায় এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। সেখানেই গড়ে তোলে জাল টাকা তৈরির কারখানা। একসময় জাল টাকার সিন্ডিকেটে কোনো মহিলা সদস্য ছিল না। এখন অনেক মহিলা সদস্য ঐ সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত হয়েছে। প্রতিটি স্তরেই ঐ সিন্ডিকেটের মহিলা সদস্য রয়েছে। কখনো গৃহিণী, কখনো কলেজছাত্রী সেজে জাল টাকা বহন করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে তারা। আবার তাদের মাধ্যমেই পণ্য কেনাকাটা করে মার্কেটে জাল টাকার বিস্তার ঘটানো হয়। সেজন্য তাদের দেয়া হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। ধরা পড়লেও তাদের আইনি সহায়তাও দেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ঈদের কেনাকাটার ব্যস্ত সময়ে অনেকে নতুন টাকা দিচ্ছেন। প্রতিটি নোট সাধারণভাবে দেখে নেয়া হয়। কিন্তু জাল নোটগুলো এতোই নিখুঁত যা শনাক্ত করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া কয়েকটি আসল নোটের সঙ্গে একটি জাল নোট দিলে তাও দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ কারণে ব্যবসায়ীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, কোরবানি ঈদে টাকা লেনদেনের পরিমাণ যেহেতু বেড়ে যায় তখন জাল নোট সরবরাহকারীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে জাল নোটের পরিমাণ কতো তা নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। ইতোমধ্যে জাল নোট প্রতারকদের গ্রেফতারে র্যাবের সব কয়টি ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে কিছু ধরাও পড়েছে। পশুর হাটগুলোয় জালিয়াতচক্র যাতে প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য প্রতিটি হাটে নোট শনাক্তকরণের জন্য মেশিন থাকবে। আর হাটগুলোর ভেতরে গোয়েন্দা নজরদারিও জোরদার করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, দেশি-বিদেশি একাধিক চক্র দীর্ঘদিন ধরে জাল টাকার ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। মূলত ঈদ সামনে রেখে চক্রটি ব্যবসায় নামে। বছরের অন্য সময় চক্রের সদস্যদের তৎপরতা তেমন দেখা না গেলেও ঈদ সামনে রেখে তারা আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐ কারণে অতীতে যারা এ ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল তাদের ইতোমধ্যেই নজরদারিতে আনা হয়েছে। গতিবিধি লক্ষ্য করা হচ্ছে। তেমন কিছু পেলে সাথে সাথেই অভিযান পরিচালনা করা হবে।