স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ঘিরে জঙ্গিদের হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা। গতকাল পান্থপথে ‘জঙ্গি আস্তানা’য় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’ অভিযানে জঙ্গি সাইফুল ইসলাম নিহত হয়েছে।
সূত্র জানায়, গুলশান হামলার পর কোণঠাসা হয়ে পড়া নব্য জেএমবি ১৫ আগস্টের শোক দিবসকে কেন্দ্র করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হামলার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের নাশকতার আগেই কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ১টি টিম নব্য জেএমবি’র এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে অভিযান চালিয়ে নাশকতার জন্য প্রস্তুতি নেয়া সাইফুল ইসলাম (২২) নামে ঐ জঙ্গিকে পরাস্ত করে। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবি’র নতুন এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়া নিঃসন্দেহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক বড় সাফল্য। জঙ্গিরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারতো। সিটিটিসি’র প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবি’র ১টি সেল বড় নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের সেই পরিকল্পনার বিষয়ে আমরা আগাম কিছু গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছিলাম। ধারাবাহিক অভিযানে কোণঠাসা নব্য জেএমবি কিছুটা মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের লক্ষ্য ছিল, ১টি বড় হামলা করা। যাতে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়া যায়। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সক্ষমতার বিষয়টি প্রচার পায়। মনিরুল ইসলাম বলেন, কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার কারণে নব্য জেএমবি নতুন করে সদস্য রিক্রুট করতে পারছিল না। এই হামলার মাধ্যমে তাদের সদস্যরা যাতে আরও বেশি চাঙ্গা হয়, সেই পরিকল্পনাও ছিল তাদের।
১৫ আগস্ট শোক দিবসের মিছিলে সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের হামলার পরিকল্পনার কথা কয়েকদিন আগেই জানতে পারে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। সিটিটিসি’র ১ জন কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন নব্য জেএমবি’র ১টি দল নতুন করে হামলার পরিকল্পনা করছে। এজন্য চলতি মাসের শুরুতেই ফিদায়ী সদস্য হিসেবে সাইফুল ইসলামকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। চলতি মাসের ৭ আগস্ট খুলনা থেকে ঢাকায় আসে সাইফুল। এরপর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের পর শোক দিবস উপলক্ষে ৩২ নম্বরে হামলার জন্য বলা হয় সাইফুলকে। এজন্য তাকে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় এঙ্প্লোসিভ। কালো ট্রাভেল ব্যাগে করে এঙ্প্লোসিভ ও সুইসাইডাল ভেস্ট নিয়ে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের ৩০১ নম্বর কক্ষটি ভাড়া নেয় সাইফুল।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ১ জন কর্মকর্তা বলেন, পান্থপথ এলাকার কোথায় যে সাইফুল অবস্থান করছে, তা তারা (সিটিটিসি) জানতে পেরেছিলেন। সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে হোটেল ওলিওতে ওঠার বিষয়টি জানতে পারেন। এজন্য গত সোমবার রাত থেকেই পান্থপথ এলাকায় ব্যাপক নজরদারি করা হয়। ভোরের দিকে হোটেল ওলিওতে সবগুলো কক্ষ তল্লাশি করতে গিয়ে ৩০১ নম্বর কক্ষের বোর্ডার ভেতর থেকে সাড়া না দিলে, তাদের সন্দেহ হয়। পরে তারা ঐ কক্ষটি বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকিয়ে রাখেন।
অভিযানে অংশ নেয়া সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলেছেন, জঙ্গি নিশ্চিত হওয়ার পর বাইরে থেকে বারবার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় সাইফুলকে। কিন্তু সে ভেতর থেকে কোনো সাড়া দেয়নি। পুলিশের ১ জন কর্মকর্তা বলেছেন, ১৫ আগস্ট উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন। এজন্য সকালে অভিযানের জন্য একটু সময় নেয়া হয়। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে সোয়াট সদস্যরা অভিযানের প্রস্তুতি নিলে জঙ্গি সাইফুল নিজে আত্মঘাতী ভেস্ট পরে বের হয়ে আসে। সোয়াট সদস্যরা গুলি করার সময় সে নিজে আত্মঘাতী হওয়ার জন্য বিস্ফোরণ ঘটায়।
বোমা বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হোটেল ওলিও সিটিটিসি’র প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আত্মঘাতী সাইফুলের সঙ্গে ৩টি বোমা ছিল। প্রথমটি দরজা ভাঙার সময় বিস্ফোরিত হয়, দ্বিতীয়টি সে নিজে ফাটায় ও তৃতীয়টি বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট নিষ্ক্রিয় করে। বোমাগুলো শক্তিশালী ছিল। এ কারণে বিস্ফোরণের সময় রুমের দেয়াল ও ব্যালকনির দেয়ালও ভেঙে পড়েছে।
সূত্র আরও জানায়, খুলনার ডুমুরিয়া এলাকার ইমাম আবুল খায়েরের ছেলে সাইফুল ইসলাম। আগে মাদ্রাসায় পড়লেও পরে খুলনার বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়তো সে। থাকতো শহরের ১টি মেসে। সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, সাইফুল সম্পর্কে যতটুকু তথ্য পেয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে অনলাইনে র্যাডিক্যাল হওয়ার পর সাইফুলের সঙ্গে নব্য জেএমবি’র ১টি সেলের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তীতে ফিদায়ী বা আত্মঘাতী সদস্য হিসেবে তাকে নির্বাচিত করা হলে সে ঢাকায় আসে।
কোণঠাসা নব্য জেএমবি’র নতুন করে হামলার চেষ্টা কী বার্তা দিচ্ছে? সিটিটিসি’র ১ জন কর্মকর্তা বলছেন, নব্য জেএমবি কোণঠাসা হয়ে গেলেও একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, এমন দাবি কখনও করা হয়নি। এখনও যারা বাইরে আত্মগোপনে রয়েছে, তারা যে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। সংগঠিত হওয়ার পাশাপাশি তারা হামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, তারা জঙ্গিদের বিস্ফোরক সংগ্রহের অনেক পথ বন্ধ করে দিলেও দেশের ভেতর থেকে নানা উপায়ে বিস্ফোরকদ্রব্য সংগ্রহের তথ্য পাচ্ছেন। বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু আস্তানায় এসব বিস্ফোরক দিয়ে বোমা তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া জঙ্গিরা নতুন সদস্যদের আগের মতো হিজরত করতেও অনুৎসাহিত করছে। হামলার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে ও সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে পরে হিজরত করতে বলা হচ্ছে। ফিদায়ী বা আত্মঘাতী হিসেবে ১ জনের বেশি সদস্যকে একসঙ্গে থাকতেও নিরুৎসাহিত করছে নব্য জেএমবি’র শীর্ষ নেতারা। সিটিটিসি’র ১ জন কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবি নতুন কৌশল নিয়ে কাজ করছে। তাদের নতুন নেতাদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযানও চলছে। একইসঙ্গে বিস্ফোরক সংগ্রহ ও বোমা তৈরিতে দক্ষ নেতাদের সবাইকে শনাক্তে নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি চলছে।
অপরদিকে রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও’তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অপারেশন আগস্ট বাইটে’ নিহত সাইফুল ইসলামের গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাঠি গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে নিহত ‘জঙ্গি’ সাইফুলের বাবা আবুল খয়ের মোল্লাকে আটক করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, নিহত জঙ্গি সাইফুলের বাবা স্থানীয় ইউনিয়ন জামায়াত নেতা। তিনি ঐ এলাকার নবাটি মসজিদের ইমাম। ইউনিয়ন জামায়াতের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিল হোসেন জানান, হোটেল ওলিও’তে নিহত ‘জঙ্গি’ সাইফুলের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাঠি গ্রামে। সে খুলনা বিএল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। ৮ দিন আগে চাকরির কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয় সে। ওসি জানান, নিহত ‘জঙ্গি’ সাইফুলের বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। অভিযান শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, নিহত সাইফুল শিবিরকর্মী ছিল। জামায়াত-শিবিরের কর্মী না হলে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীর দিন কেউ এমন ঘটনা ঘটাতে পারতো না। তিনি বলেন, আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে হামলা হতে পারে। এ কারণে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াই। এরই অংশ হিসেবে গত সোমবার আমরা ওলিও হোটেলে তল্লাশি চালাই। সব রুম তল্লাশির পর ৩০১ নম্বর রুম থেকে কোনো সাড়া দেয়নি। এরপর আমরা তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করি, তাকে ঘিরে রাখি। গতকাল সকালের দিকে যখন আমরা নিশ্চিত হই সে জঙ্গি, তখন তাকে আমরা আত্মসমর্পণের কথা বলি। সে আত্মসমর্পণ না করে প্রথমে ১টা বিস্ফোরণ ঘটায়, সেই বিস্ফোরণে হোটেলের দরজা ভেঙে যায়। দ্বিতীয় বিস্ফোরণের সময় যখন সে বের হয় তখন পুলিশ তাকে গুলি করে এবং সে মারা যায়।