মশিউর রহমান রুবেল/ কাজী মোস্তাফিজুর রহমান শুভ :উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’ শ্লোগানকে সামনে রেখে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশ গড়তে ৮ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। উচ্চাভিলাষী এই বাজেট বাস্তবায়নে প্রধান দৃষ্টি দেয়া হয়েছে করের উপর। আর উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় করের বোঝা বাড়ায় বৃদ্ধি পাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও আইসিটি খাতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন টানা দুই মেয়াদের মহাজোট সরকারের ৮টি বাজেট মন্দের ভালো হলেও। এবারই করের বোঝা নিয়ে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। চ্যালেঞ্জটি মূলত নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আইন কার্যকর করা নিয়ে। যার ফলে স্বস্তি মিলছে না দেশের জনগণের।
প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে দেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই বাজেট হচ্ছে সরকারের টাকা আয়ের বাজেট। সরকার টাকা আয় করবে আর সরকারই ভোগ করবে। শিল্প-বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানের বাড়বে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, বিশাল বাজেটের জন্য সাধারণ মানুষের পকেট কেটে টাকা আদায় করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বাজেটে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১১ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া, এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ০.৪ শতাংশ। কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১.৪ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১০.৮ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা যা জিডিপি’র ৬.৯ শতাংশ এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের বরাদ্দ ১০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। এর ফলে এডিপির মোট আকার হলো ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৭.৪ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপি’র ৫ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ২.৩ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। যা জিডিপি’র ২.৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১.৩ শতাংশ এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। এরপরই রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করেন।
এছাড়াও অর্থমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট পেশ করেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের চতুর্থ বাজেট। এছাড়া গত বছরের মতো এবারও সংসদে বিরোধীদলের উপস্থিতিতে বাজেট পেশ করা হলো। এসময় রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল টেবিল চাপড়ে ‘২০১৭-১৮’ অর্থবছরের উত্থাপিত বাজেট সমর্থন করেন।
অর্থমন্ত্রী বেলা ১টা ৩৬ মিনিটে বাজেট বক্তৃতার শুরুতে ভুল করেন অর্থমন্ত্রী! এসময় অর্থমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে ১৯১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন। পরক্ষণেই স্পিকার তার এই ভুল সংশোধন করে দেন। বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট। পরে অর্থমন্ত্রী ভুল সংশোধন করে নেন।
এরপরই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৪ জাতীয় নেতা, মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণতন্ত্র ও মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে আত্মদানকারী শহীদ, ‘৭৫-এর কালোরাত্রিতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার বঙ্গবন্ধুর নিষ্পাপ স্বজন এবং অন্যান্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে সাথে নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদে রাষ্ট্রপতির গ্যালারিতে বসে বাজেট বক্তৃতা শোনেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ বিভিন্ন বিদেশী কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, বিশিষ্ট আমন্ত্রিত ব্যক্তি এবং ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারাও সংসদ ভবনে উপস্থিত থেকে বাজেট বক্তৃতা শোনেন।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামোগত খাতে মোট বরাদ্দের ২৯ দশমিক ৩১ শতাংশ, যার মধ্যে মানব সম্পদ খাতে- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট খাতে ২৬.১২ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ৩১.৭৪ শতাংশ- যার মধ্যে রয়েছে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৩.০২ শতাংশ, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ১১.৮৮ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৫.২৮ শতাংশ।
এছাড়া সাধারণ সেবা খাতে ২৪.০৩ শতাংশ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ ১.৮৮ শতাংশ। এছাড়া সুদ পরিশোধ বাবদ ১০.৩৬ শতাংশ। নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে অবশিষ্ট ২.৬৮ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।