বিশেষ প্রতিনিধি : সোনা কোনো নিষিদ্ধ পণ্য নয়। আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১০১৮ এর অনুচ্ছেদ ২৬(২২) অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সোনা আমদানির স্পষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হয়। এই অনুমতি নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৈধভাবে যেকোনো সময় ও যেকোনো পরিমাণ সোনা আমদানি করতে পারেন। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে সোনা আমদানির অনুমতি চেয়ে একটি আবেদনও করেনি কেউ।
এদিকে চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশের অভ্যন্তরে আটককৃত সোনা জমা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাজেয়াপ্ত করা এসব সোনা পরবর্তীতে নিলামে বিক্রি করার বিধান রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ধরনের বাজেয়াপ্ত সোনার কোনো নিলাম অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে পরিমাণ সোনা দেশে কেনাবেচা হচ্ছে তার সবটাই চোরাই পথে আনা বা অবৈধভাবে। বৈধভাবে স্বর্ণ আনার সুযোগ থাকার পরও চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধভাবে আনার নেপথ্যে রয়েছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যে সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি কোনো সরকারই। চোরাচালানের সময় বাহক ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে মূলহোতারা। পরবর্তীতে ঐসব ধরা পড়া বাহকদের কৌশলে ছাড়িয়ে নেয়া হয় এবং পরবর্তী একই কাজ করানো হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র গত চার বছরেরও কম সময়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর উদ্ধার করেছে এক টনেরও বেশি সোনা। এসব সোনার দাম ৫২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। উদ্ধার করা এসব সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের হিসাব বলছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫১ দশমিক ৫৪ কেজি সোনা যার দাম ৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা সোনার পরিমাণ ৬৪১ দশমিক ৯০৮ কেজি যার দাম ৩০১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা সোনার পরিমাণ ২০৩ দশমিক ৫৪ কেজি যার দাম ৯৮ কোটি এক লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা সোনার পরিমাণ ৬৯ দশমিক ২৪ কেজি যার দাম ৩৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত উদ্ধারকৃত সোনার পরিমাণ ৮৫ দশমিক ৯৮ কেজি যার দাম ১৯ কোটি এক লাখ টাকা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর থেকে বলা হয়, আটককৃত বিপুল পরিমাণ সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। আর দেশের সোনা ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের ভেতরের উৎস থেকে বৈধ সোনা পাওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে তাদের ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) নেতারাও দীর্ঘদিন ধরেই ‘বাংলাদেশে বৈধ সোনা সরবরাহের ব্যবস্থা করার’ দাবি করছেন। পাশাপাশি সোনা আমদানি ও নীতিমালা নিয়ে নতুন করে ভাবতেও বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর দেশে সোনার চাহিদা রয়েছে প্রায় ২১ টন। সারাবছর এ পরিমাণ সোনার অলঙ্কারই বিক্রি হচ্ছে সারাদেশে। হিসাব অনুযায়ী ২১ টন সোনার সমপরিমাণ হচ্ছে ১৮ লাখ ৪শ ১১ ভরি।
এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ যাত্রীর সাথে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসে। নির্দিষ্ট পরিমাণের (একশ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি) বেশি সোনা আনলে প্রতি ভরিতে ৩ হাজার টাকা হিসাবে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। চাহিদার বাকি ৯৫ শতাংশ বৈধভাবে আমদানি করলে এ হিসাবে (ভরিতে ৩ হাজার টাকা) সরকার প্রায় ৫শ ১২ কোটি টাকা রাজস্ব পেত। কিন্তু এ পরিমাণ সোনা বৈধভাবে আমদানি না হওয়ায় প্রতিবছর সরকার ৫শ ১২ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
সম্প্রতি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ‘অবৈধ সম্পদ’ খুঁজতে তাদের প্রতিষ্ঠানের ৫টি বিক্রয়কেন্দ্রে ১৪ মে অভিযান চালায় শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। আপন জুয়েলার্সের ৫টি দোকানে গত ১৪ ও ১৫ মে শুল্ক গোয়েন্দার অভিযানে সাড়ে ১৩ মণ সোনা ও ৪২৭ গ্রাম ডায়মন্ড আটক করে শুল্ক কর্মকর্তারা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এবং প্রমাণের আলোকে আপন জুয়েলার্সে এ অভিযান পরিচালিত হয় বলে জানায় শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। ১৭ মে তলব করা হয় আপন জুয়েলার্সের মালিককে। শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ জানায়, এই
বিপুল পরিমাণ সোনার বিপরীতে কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির মালিক দিলদার আহমেদ।
এদিকে সোনা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করার অভিযোগ এনে এবং স্বর্ণ আমদানিতে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে গত ১৯ মে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয়। তবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের সাথে বাজুস নেতৃবৃন্দের বৈঠকের পর প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সিন্ডিকেটের লোকজন প্রায় প্রতিদিনই তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবৈধভাবে সোনা আনছে দেশে। দেশের সোনার চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বর্ণালঙ্কারের চাহিদা মেটাতে সোনার বার দুবাই, মালয়েশিয়া, ওমান, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশ হয়ে স্থলবন্দর ও স্থলসীমান্ত দিয়েও পাচার করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এই সোনা পাচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটে বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গোয়েন্দা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগ, কাস্টমস ও বাংলাদেশ বিমানের শতাধিক কর্মী টাকার বিনিময়ে পাচারকারীদের সহায়তা করছেন। এছাড়াও সোনা চোরাচালানের সাথে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৮, চট্টগ্রামে শাহ আমানতে ৫ ও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে ২টি চক্র সক্রিয়ভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়াও বিমানবন্দর ও বিমানে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে ঐ প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছেন। এসব অসাধু কর্মকর্তাদের মধ্যে জড়িত রয়েছেন বিমান বাংলাদেশের কয়েকজন পাইলট, কো-পাইলট, কেবিন ক্রু, ফ্লাইট স্টুয়ার্ট, চিফ পার্সার, জুনিয়র পার্সার ছাড়াও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
চোরাকারবারিরা কৌশল পরিবর্তন করায় তা কমে গেছে। তবে কোনোভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না সোনা চোরাচালান। তবে বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তি ও পাচারকারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সোনা চোরাচালান ধরা পড়ে। এ পর্যন্ত যত সোনা আটক হয়েছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হয়েছে নিরাপদে। পাচারকারীরা প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন কৌশল, রুট পরিবর্তন এনে পাচার কাজ চালিয়ে যচ্ছে। কখনো শরীরের ব্যান্ডেজে, কখনো পায়ুপথে, হুইল চেয়ারে, জুতা, স্যান্ডেল, বেল্ট, সাবান কেস, ল্যাপটপের ভেতর-অদ্ভুত সব কায়দায় সোনা পাচার হচ্ছে।