সুন্দরবনে মধু আহরন শুরু

মধু

বি এম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: বিভিন্ন মৌসুমের মধ্যে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ন মৌসুম মধু মৌসুম। সুন্দরবনে আনুষ্ঠানিকভাবে মধু আহরন শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের মধু ও মোম দেশের একটি অন্যতম অর্থকারি সম্পদ। বিভিন্ন প্রকার ঔষধ তৈরী ও ঔষধী খাবার হিসেবে মধুর জুড়ি মেলা ভার। বিশ্ববিখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনে প্রাকৃতিভাবে সৃষ্টিকর্তা যে মধুর চাক দিয়েছেন তার গুনাগুন অনস্বীকার্য। তবে অনেক ক্ষেত্রে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ মৌয়লরা সরকারী নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা করছে না। মৌয়লরা মধু সংগ্রহের নিয়মনীতি উপেক্ষা করার কারনে মধু উৎপাদন হ্রাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছির বংশ ধ্বংস হচ্ছে। সুন্দরবনে প্রতি বছর ১ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন- এ তিন মাস মৌয়ালদের মধু ও মোম সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়। মৌসুমের শুরুতেই গত রবিবার থেকে মৌয়ালরা পারমিট নিয়ে শত শত নৌকা যোগে দল বেধে মধু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুন্দরবনে যাত্রা করেছে। মৌয়ালরা যাতে নিয়মনীতি মেনে মধু ও মোম সংগ্রহ করে সে লক্ষ্যে সমপ্রতি সন্দুরবন পশ্চিম বন বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন সচেতনতামুলক কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়। টেকসই পদ্ধতিতে সুন্দরবন সম্পদ আহরণের মাধ্যমে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ মৌয়াল সমবায় সমিতির মোট ৫০ জন মৌয়াল সদস্যকে সম্পৃক্ত করে ৩ দিনব্যাপী সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে এবং টেকসই পদ্ধতিতে সুন্দরবন সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় সমবায় মধু সংগ্রহ করার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন দলীয় কাজের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা কি তা আলোচনা করা হয়। আলোচনা সভায় উপসি’ত মৌয়ালগণ সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ টিকিয়ে রেখে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করায় সকলকে নিজ নিজ অবস’ান থেকে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

মধু

 

সূত্রমতে, সমপ্রতি বন বিভাগের সুন্দরবন সার্কেলের বন সংরক্ষক মো: জহির উদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে বুড়িগোয়ালিনীতে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তিনি যোগদানের পর এ খাতে রাজস্ব আদায় বাড়বে এবং সুন্দরবন সুরক্ষা থাকবে এমন আশাবাদ পরিবেশবাদীদের। মৌয়ালরা বন বিভাগের সতর্ক পাহারার কারণে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে মধু সংগ্রহ করতে পারবে। তাছাড়া মৌয়ালরা আগের তুলনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবে। সেমিনারে ডিএফও সকল মৌয়ালদের যাবতীয় দিক নির্দেশনা দেন। সিএফ জহির উদ্দিন বলেন, আমি আশা করি চলতি মৌসুমে মৌয়ালরা যথারীতি নিয়ম কানুন মেনে এ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে। মৌমাছির প্রজনন যাতে বাধাগ্রস- না হয় এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যেভাবে মধু আহরন করলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্যক জ্ঞান দান করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মৌয়ালরা যাতে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে অগ্নিকান্ডের সূতপাত বা অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারে সে বিষয়ে বিশেষ সচেতন করা হয়। আশা করছি চলতি মৌসুমে গত বছরের তুলনায় বেশি মধু সংগ্রহ করা যাবে। তাছাড়া এবার মৌয়ালদের কর্মকান্ডের প্রতি বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে।
সূত্রমতে, ১০০০ টাকা মধু ও ৭৫০ টাকা মোমের প্রতি কুইন্টালে রাজস্ব নির্ধারন করা হয়েছে। এ খাত থেকে গত বছর সাড়ে ১২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এ বছর ১৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ে হবে বলে আশা করছে বন বিভাগ। এবার ৬ হাজার মণ মধু ও ১৫ শ’ মণ মোম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ হাজার মৌয়াল মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে যায়। মৌয়ালরা জানায়, মধু সংগ্রহের জন্য তারা খড়কুটা একত্রিত করে “উকো বা বড়পা” প্রস’ত করে তাতে আগুন ধরিয়ে জঙ্গলে ধোয়া ছেড়ে দিল মৌমাছি বের হয়ে মৌচাকের দিকে ধাবিত হয়। তখন তারা তাদের পিছু নিয়ে মৌচাকের সন্ধান পায়। মধু সংগ্রহের পূর্বে মৌয়ালরা আগুনের ধোয়া দিলে ঝাকে ঝাকে মৌমাছি চাক ছেড়ে উড়ে যায়। সুন্দরবনে লোকেরা তাকে “বৈলেন দেয়া” বলে। মৌমাছি সরে গেলে চাক থেকে তারা মধু ও মোম সংগ্রহ করে। বন বিভাগের নিয়ামানুযায়ী ধোয়ার কুন্ডলী দিয়ে মৌমাছি তাড়িয়ে মধু সংগ্রহের নিয়ম থাকলেও মৌয়ালরা এ নিয়মের কোন তোয়াক্কা করে না। কম পরিশ্রমে অধিক লাভবান হওয়ার আশায় বন বিভাগের আইন উপেক্ষা করে মৌয়ালরা মৌচাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে হাজারো মৌমাছি পুড়ে যায়। যার কারনে মৌমাছির বংশবিস-ার বাধাগ্রস- ও মধু উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে । পাশাপাশি মৌয়ালদের ধরানো আগুনে যে কোন সময় বৃহৎ বনের অসি-ত্বের জন্য হুমকীস্বরূপ হতে পারে। আর এ কারনেই মাঝে মধ্যে সুন্দরবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে মৌয়ালরা পদে পদে বিপদ তথা জীবনের ঝুকি নিয়ে প্রতিবছর ৪ থেকে ৫ হাজার মণ মধু সংগ্রহ করে। নিয়মনীতি উপেক্ষা তথা পরিকল্পিতভাবে মধু সংগৃহীতে না হওয়ায় মধু সংগ্রহের পরিমান হ্রাস পেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত এক দশকে মধু আহরন গড়ে আড়াই হাজার মন। কিন’ নব্বই দশকে মধু আহরন হয়েছিল গড়ে ৪ হাজার ৪ শ ৪৫ মন। ঐ সময় মোম আহরন হয়েছিল ১ হাজার ১শ ৩৫ মন। তবে এ বছর বিভিন্ন গাছে ফুল ফোটার পরিমান অনেক বেশী। সে কারনে মৌচাক বৃদ্ধিসহ এ বছর মধু সংগ্রহের পরিমানও বাড়তে পারে।
অপরদিকে পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও বলেন, আমার ডিভিশনে অপেক্ষাকৃত মধু কম । আনুষ্ঠানিকভাবে গত শনিবার থেকে মধু সংগ্রহ শুরু হলেও আরও কয়েক দিন লাগবে বাস-বে শুরু হতে । তবে পারমিট সংগ্রহের সময় আমরা মৌয়ালদের প্রয়োজনীয় মোটিভেশন দিয়ে দিবো। তাছাড়া এবার মধু আহরনকালে বিশেষ তদারকি করা হবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post