বি. এম রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: পানি পরিষ্কার রাখা ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে শামুক। একসময় ছোট বড় মিঠা পানির পুকুর, বিল, বাঁওড়, খাল, নদী, জলাশয়, জলাভূমিতে পরিবেশবান্ধব শামুকের বিচরণ ছিল। বর্তমানে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী শামুকের আবাসস’ল ধ্বংস, ছোট ও ডিমওয়ালা শামুক আহরণ সর্বোপরি মানুষের অত্যাচারে বিলুপ্তির পথে।
সূত্রমতে, খুলনার রায়েরমহল, আড়ংঘাটা, ফুলতলা ও ফকিরহাটের ফলতিতা বাজারে এ অঞ্চলের সবথেকে বড় শামুক কেনাবেচার হাট বসে। প্রতিদিন খুলনার রায়েরমহল বাজারে ২শ’ বস-া, আড়ংঘাটায় ২শ’ বস-া, ফুলতলায় এক থেকে দেড় হাজার বস-া ও ফকিরহাট ফলতিতা বাজার এলাকায় দেড় থেকে দু’হাজার বস-া শামুক বিক্রি হয়। এছাড়া স’ানীয়ভাবে দিঘলিয়া, বারাকপুর, শাহপুর, ডুমুরিয়া বাজার, শিরোমণি, জামিরা, যশোর, মণিরামপুর, কেশবপুর, কলারোয়া, বটিয়াঘাটা, কৈয়া বাজার, বাগেরহাট চিতলমারী, কচুয়া, মোল্লাহাট এলাকায় বসে ক্ষণস’ায়ী বাজার। আর এ বাজারগুলোতে বেচাকেনা চলে বছরের ভাদ্র মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন-।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল এলাকায় ফসলী জমিতে ঘের তৈরি হয়। একারণে একদিকে বাগদা চাষের জন্য লবণ পানি ব্যবহার অপরদিকে গলদা চিংড়ির চাষ শুরু হলে এই চিংড়ির খাদ্য হিসেবে শামুকের মাংস (গ্যাতা) ব্যবহৃত হয় আবার শামুকের খোলস বা খোলা দিয়ে চুন তৈরি, ঘেরের পানি পরিষ্কার করার পাউডার তৈরি, পোল্ট্রি ফার্মে মুরগির খাদ্য ও ফিসমিল তৈরির উপকরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। প্রতিবছর ব্যাপকহারে ছোট ও ডিমওয়ালা শামুক আহরণ করার ফলে এ অঞ্চলসহ পার্শ্ববর্তী জেলার জলাভূমি থেকে শামুক কমে যাচ্ছে। শামুক আহরণের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও শামুক কমে যাবার আরেকটি কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সময়মত বৃষ্টিপাত না হওয়ায়, পর্যাপ্ত বর্ষা না হওয়ায়, মিঠা পানির জলাশয়ে লবণাক্ততার প্রভাব আসায় শামুকের বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস- হচ্ছে।
রায়েরমহল বাজার এলাকার রত্না বেগম বলেন, ‘অভাবের জন্য এ কাজ করি। পরিবেশের কি হয় তা জানি না। এক বস-া শামুক ভেঙে এর গ্যাতা (মাংস) বাইর করে দিলি ৬৫ টাকা পাবো। আমি তাই জানি।’
খুলনা ডুমুরিয়া উপজেলার শাহপুর এলাকার ঘের মালিক মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, ‘মাছের ঘেরে যদি শামুক দেওয়া যায় তাহলে অনেক লাভ হয়। মাছ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়, তাজা হয়। সে কারণে ঘের মালিকরা তাদের ঘেরে শামুক দেয়। অল্প সময়ে বেশি লাভ করতে এ খাবার দেওয়া হয়। পরিবেশ নিয়ে আমরা ভাবি না।’
রায়েরমহল বাজারের শামুকের আড়তদার মাহবুব জোমাদ্দার বলেন, ‘এ এলাকার প্রায় ২ হাজার মানুষ শামুক ভাঙার কাজে নিয়োজিত আছে। এ কাজ বন্ধ হলে তারা খাবে কি? ঢাকা শ্রীণগর, গোপালগঞ্জ, পাবনা, সিলেট, কুষ্টিয়া, মাগুরা, নাটোর, চাটমোহরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এ শামুক আসে। একদল শিকারি বিল, হাওড়-বাঁওড় থেকে শামুক কুড়িয়ে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে। ফড়িয়ারা ব্যাপারীর কাছে, ব্যাপারীরা আড়তদারের কাছে এবং সবশেষ ঘের মালিকরা কিনে নিয়ে এলাকার গরীব মানুষদের দিয়ে ভেঙে নেয়। পরিবেশ নিয়ে ভাবার সময় কই। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভারনমেন্টাল সাইন্স ডিসিপ্লিনের প্রফেসর বলেন, শামুক মূলত মাটির ক্যালসিয়াম কার্বোনেট বৃদ্ধি করে। মাটির গুণগতমান ঠিক রাখে। পানি ফিল্টারিং এর কাজ করে। সেজন্য এটি কমে গেলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে। মাটির এসিডিটি বেড়ে যাবে ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাবে। শামুককে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে বহু প্রাণী বেঁচে আছে। শামুক হারিয়ে গেলে সে সমস- প্রাণীও হারিয়ে যাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার পরিচালক (উপ-সচিব) বলেন, শামুক সাধারণত নিচু এলাকায় মিঠা পানিতে জন্মায়। এ অঞ্চলে লবণ পানির প্রভাব বৃদ্ধি এবং মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহারের জন্য শামুক কমে যাচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে শামুক হারিয়ে যাবে। পরিবেশের ভারসাম্য বাধাগ্রস- হবে। সেকারণে মৎস্য অধিদপ্তরের উচিত হবে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ শুরু করা।
বর্ষা মৌসুমে শামুকের আধিক্য লক্ষ্য করা যায় এবং শুকনা মৌসুমে শামুক মাটির নিচে আশ্রয় নেওয়ার তার দেখা পাওয়া দায় হয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে শামুক মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে এবং বংশ বিস-ার শুরু করে। এভাবেই চলে শামুকের জীবনচক্র। আহরণকারীদের সচেতনতা, ছোট ও ডিমওয়ালা শামুক ধরা থেকে বিরত থাকা এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ শুরু করলে আবারও প্রকৃতির বন্ধু শামুকের আধিক্য লক্ষ্য করা যাবে।
বি এম রাকিব হাসান,
খুলনা ব্যুরো: