বৃহত্তর খুলনায় জনপ্রিয় হচ্ছে বায়োগ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে জ্বালানি

 
বি. এম. রাকিব হাসান, খুলনা: এখনো বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে পাইপ লাইনে গ্যাস আসেনি। এ প্রকল্পটির কাজ চলছে। কিন’ এ অঞ্চলের জ্বালানী সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। প্রতিনিয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়ছে। যে কারনে জনপ্রিয় হচ্ছে বায়োগ্যাস। এতে সাশ্রয় হচ্ছে জ্বালানির। গরুর গোবর দিয়ে এখন অনেকেই লাকড়ী তৈরী করছে না। এতে সময়ের অপচয় এবং শ্রম অনেক বেশি যায়। যে কারনে গ্রামে গঞ্জে শহরে-বন্দরে, গড়ে ওঠা হাজার হাজার মুরগির ফার্মের মুরগির বিষ্ঠা, গরুর গোবর ও মানুষের মলমুত্র দিয়ে তৈরী হচ্ছে বায়োগ্যাস। সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য অথবা যে কোন স’ানের বর্জ্য দিয়েও এ প্ল্লান্ট চলছে সফলভাবে। জ্বালানি সংকটের যুগে এটি একটি আশার আলো। এর কারনে যে কোন মধ্যবিত্ত পরিবারে উপার্জনের পাশাপাশি সাংসারিক জ্বালানি ব্যায় দারুনভাবে সাশ্রয় করছে।
মানুষের এক সময়ের অব্যবহৃত এসব উচ্ছিষ্ট দিয়েই এখন তৈরী হচ্ছে বায়োগ্যাস বা বিকল্প জ্বালানি। এ জ্বালানি ব্যবহার করে খুলনা মহানগরীতে একটি পরিবার প্রতি মাসে প্রায় ৫-৭ হাজার টাকা সাশ্রয় করছে। ক্রমান্বয়ে এ গ্যাসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে খুলনা জেলায় প্রায় ৫ শতাধিক বায়োগ্যাস প্লান্ট গড়ে উঠেছে।
বেসরকারি বেশকিছু সংস’া এ প্ল্লান্ট কিসি-র মাধ্যমে নির্মান করিয়ে জনগনের মধ্যে উদ্বুদ্ধ করেছে। একই সাথে সরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে শুনে অনেকেই রাজমিস্ত্রীদের মাধ্যমে এ প্ল্লান্ট তৈরী করছে। সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী লিমিটেড (ইউকল)’র একটি সূত্র জানান, জাতীয় গার্হস’্য বায়োগ্যাস ও জৈব সার কর্মসূচীর আওতায় ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি শুরু হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৫ সহস্রাধিক প্ল্লান্ট তৈরী হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ৩ হাজার ৮১৮ প্লান্ট রয়েছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র খুলনা জেলায় বায়োগ্যাস প্লান্ট সংখ্যা ৩৮৪টি। তবে বেসরকারী পর্যায়ে এর সংখ্যা ৫ শতাধিক। প্রতিনিয়ত এর পরিমান বাড়ছে। এই সূত্রটি জানান, পচনশীল যে কোন জৈব পদার্থ যেমন, গরুর গোবর, মুরগির বিষ্ঠা এবং মানুষের মলমূত্র বায়ুশুন্য অবস’ায় রাখলে সেখান থেকে উৎপন্ন হওয়া গ্যাসই বায়োগ্যাস বা বিকল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে পরিচিত। এ গ্যাস জ্বালানি হিসেবেু খুবই উপযোগী। এতে কোন গন্ধ নেই, ধোঁয়া হয়না, হাড়ি-পাতিল ও রান্নাঘরে কালি পড়েনা, কেরোসিন, কাঠ বা খড়কুটা লাগে না। ফলে জ্বালানি খরচ বেঁচে যায়। এছাড়া এ গ্যাস দিয়ে গ্যাস বাতিও জ্বালানো যায়।
সূত্রমতে, খুলনায় পাইপ লাইনে গ্যাস না থাকা এবং গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় খুলনা মহানগরীতে বায়োগ্যাস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকেই বাড়িতে গ্যাসের প্লান্ট তৈরী করে রান্নার জ্বালানির পাশাপাশি প্রতিবেশিদেরও লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করে বাড়তি অর্থ আয় করছে। এমনই একজন খুলনা নগরীর বয়রা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী শেখ মাহফুজুর রহমান টিটো। তিনি গত দুই বছর যাবৎ বায়োগ্যাস ব্যবহার করে জ্বালানি সাশ্রয় করছেন। মো: শাহ আলম বলেন, মূলত তিনি নিজ বাড়ির আঙ্গীনায় গরুর খামার করছেন ২০০৮ সাল থেকে। বর্তমানে খামারে ১২টি গরু রয়েছে। ২০০৯ সালের দিকে তিনি প্রথম বায়োগ্যাসের কথা জানতে পারেন। তখন ইডকলের নির্মান সহযোগী ও বাস-বায়নকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীন শক্তির মাধ্যমে তিনি বাড়িতে গ্যাস প্লান্ট নির্মান করেন। ৪ দশমিক ৮ কিউবিক মিটার সাইজের এ প্লান্টের নির্মান ব্যয় হয়েছে মোট ৪৪ হাজার ৪৫৩ টাকা। এর মধ্যে তিনি ডাউন পেমেন্ট করেছেন মাত্র ৫ হাজার ৩১৮ টাকা। বাকি টাকা প্রতি মাসে কিসি-র মাধ্যমে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ইডকল থেকে তিনি ৯ হাজার টাকা ভর্তুকি পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে তিনি বর্তমানে ৬টি চুলা জ্বালাতে পারছেন। বাড়ির যাবতীয় রান্না এবং গরুর খাদ্য জ্বালানির কাজও এই গ্যাসে চলছে। ফলে প্রতি মাসে তার ৬টি গ্যাস সিলিন্ডার কেনার অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া গ্যাস উৎপাদনের পর থাকা বর্জ্য (বায়োগ্যাস রেসিডিউ বা ম্লারি) বিক্রি করেও তার গরুর খাবারের খরচ যোগান হচ্ছে। এভাবে মাসে তার ৬ হাজার টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। বায়োগ্যাস রান্নার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মো: শাহ আলমের স্ত্রী মিসেস রোকেয়া বলেন, পাইপ লাইনে বা সিলিন্ডারের গ্যাসও সব সময় পাওয়া যায় না। কিন’ বায়োগ্যাস সব সময় পাওয়ার নিশ্চিয়তা রয়েছে। ফলে ইচ্ছামতই ব্যবহার করা যায়। এ গ্যাস ব্যবহার করে তিনি স্বসি-তে আছেন বলেও উল্লেখ করেন। এব্যাপারে ইউকলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হক ফয়সাল বলেন, দেশের মাত্র ৩% জনগন পাইপ লাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসে রান্না করার সুযোগ পায়। যাদের অধিকাংশই শহরে বসবার করে। অথচ মোট জনসংখ্যার ৭০ বাগ গ্রামে বসবাসকারী এ সুবিধ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের কতা চিন-া করলে গ্রামীন জনপদে পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব। ফলে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে জার্মান টেকনিক্যাল কো-অপারেশন (জিপিজেড)’র সাসটেইনেবল এনার্জি ফল ডেলেভপমেন্ট, এসইডি’র কর্মসূচী কর্মকর্তা এক প্রকৌশলী বলেন, জিটিজেড ২০০৫ সাল থেকে দেশে বায়োগ্যাস প্রযুক্তি সমপ্রসারনের উদ্যোগ নেয়। এ কর্মসূচির আওতায় ৬ ঘন মিটারের চেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মান এবং বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও মানুষের মলমুত্র, কসাইখানার পশুর বর্জ্য, হাট-বাজার ও পৌরসভার বর্জ্য, ব্রয়লার মুরগির বিষ্ঠা ইত্যাদি থেকে বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মান এবং জৈব সার উৎপাদনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিক ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post