জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে
বাড়ছে ভূমিকম্পের ঝুকিও
বি. এম. রাকিব হাসান, খুলনা ব্যুরো: পদ্মা সেতু নির্মানের আভাসে শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য খুলনাঞ্চলে আবাদি জমি হুমকির মুখে পড়েছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এখন ঝুকেছে এ অঞ্চলে। তাদের ধারণা যে কোন ভাবেই হোক পদ্মা সেতু খুব তাড়াতাড়ি চালু হবে। ফলে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নে কৃষি জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। কৃষি জমি বালি দিয়ে ভরাট করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন উপ-শহর। সেই সাথে স’াপনা হচ্ছে নতুন নতুন মাঝারী ও ভারী শিল্প-কারখানার। ফলে এক দিকে কৃষি উৎপাদন কমে খাদ্য ঘাটতির বাড়ছে। জীব বৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে। বাড়ছে ভূমিকম্পের ঝুকিও। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত ১৮ বছরে খুলনা মহানগরী ও জেলায় ৯ হাজার ১৬০ হেক্টরেও বেশি কৃষি জমি কমে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুলত ২০০৪ সালের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের আইনশৃংখলা পরিসি’তি ও যোগাযোগ ব্যবস’ার উন্নয়ন হওয়ায় এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করে। ফলে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বড় বড় বিনিয়োগকারী এ অঞ্চলে পুনরায় বিনিয়োগ শুরু করে। এতে করে এখানকার বড় বড় সড়ক মহাসড়কের পাশের জমির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায। বড় বড় ব্যবসায়ীরা খুলনা মহানগরীসহ সড়কগুলোর পার্শ্ববর্তী এলাকার ফসলি জমি কিনে তা বালি ভরাট করে গড়ে তুলছে নানা স’াপনা । কেউ বা প্লট তৈরী করে ব্যবসা করছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মানের তোড়জোড় এবং মংলা বন্দরের আধুনীকায়নে উদ্যোগ গ্রহন করার পর অর্থশালী ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি পড়ছে এ অঞ্চলের কৃষি জমির ওপর।
কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৮ বছরে খুলনার কৃষি জমি কমেছে ৯ হাজার ১৬০ হেক্টর। ১৯৯৩ সালে খুলনা মহানগরী ও জেলায় কৃষি জমি ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭২৪ হেক্টর। চলতি বছর তা কমে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৬৪ হেক্টর দাড়িয়েছে।
কৃষি জমি কমে যাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে খুলনা কৃষি সমপ্রসারন অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষন বিশেষজ্ঞ বলেন, কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন কমছে। ফসল উৎপাদন কমছে। খাদ্য ঘাটতি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, প্রতি বছর যে হারে কৃষি জমি কমছে তাতে এক সময় কৃষি জমি খুজে পাওয়া যাবে না। সমপ্রতি বেসরকারি কৃষি গবেষনা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এগ্রিরিসার্স এন্ড সাসটেইনেবল এনভারমেন্ট এন্ড এন্টারপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জমি ভাগ করা, অপরিকল্পিত চাষ ও ব্যবহারের কারণে দেশে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর আবাদি জমি হারাচ্ছে। তাদের মতে নীতিমালা এবং সচেতনতার অভাবে কৃসি জমি অনুৎপাদন খাতে চলে যাচ্ছে। যে হারে কৃষি জমি কমছে তাতে আগামী ২০ বছর পর দেশে জমির পরিমান মাত্র ৫০ হাজার হেক্টরে নেমে আসবে বলে ওই প্রতিবেদনে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। বিনিয়োগ বোর্ড খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৭ বছরে খুলনাতে নতুন মাঝারি ও ভারি শিল্প স’াপন হয়েছে শতাধিক। এর মধ্যে শুধুমাত্র জুটমিল স’াপন হয়েছে ২০টি। যা ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। নতুন আরো ৫টি জুটমিল নির্মাণাধীণ রয়েছে। যার সবগুলোই নির্মিত হয়েছে দু’ফসলি জমি ভরাট করে। কৃষি জমি কমে যাওয়ার পরিবেশেও প্রভাব পড়ছে দাবি করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড: দিলিপ কুমার দত্ত বলেন, অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমি ব্যবহারের জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। নষ্ট হচ্ছে মাটির উপরিভাগের মিষ্টি পানির আধার। পানি সংকট বাড়ছে। দীর্ঘ মেয়াদী সুফল কমে যাচ্ছে। কেননা জমির ওপর কোন স’াপনা নির্মান করলে নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন- তার সুফল আসে। কিন’ কৃষি জমিতে শত শত বছর কৃষি পন্য উৎপাদন করা সম্ভব। এ হিসেবে লাভের পরিমানটাই বেশি। একই ডিসিপ্লিনের সহযোগি অধ্যাপক ড: মো: মুজিবুর রহমান বলেন, নগরীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমি, জলাশয় ভরাট করে বহু আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে। এতে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। মাটির উপরিভাগের মিষ্টি পানির আধার যেমন পুকুর, জলাশয়, খাল বিল ভরাট হয়ে পানির সংকট সৃষ্টি করছে। চাপ বাড়ছে ভু-গর্ভস’ পানির ওপর। এতে ভূ-গর্ভস’ পানির স-রও দ্রুত নিচে নামছে। ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের আশংকা রয়েছে। তিনি পরিকল্পিতভাবে জমির ব্যবহার এবং গ্রামীন এলাকার জন্য মডেল হাউস নির্মান এবং পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ওপর মন-ব্য করেন।
নতুন আইন হচ্ছে
ভুমি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, কৃষি জমি ব্যবহারের নতুন আইন হচ্ছে। জমি যাতে ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত না হয় সে কথা বলা হয়েছে। আইনে বসত ভিটার জন্য কৃষি জমিকে বেছে না নিয়ে গ্রামীন এলাকার জন্য মডেল হাউস নির্মান এবং পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা তৈরীর কথা বলা হয়েছে। সামাজিক বনায়নকে উৎসাহী করাসহ বিদ্যমান জলাশয় উন্মুক্ত রাখার বিধান রাখা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য কৃষি জমি অধিগ্রহন ছাড়া বিকল্প ব্যবস’া না থাকে সে ব্যাপারে কৃষি জমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। চিহ্নিত অঞ্চল ছাড়া কোথাও শিল্প কারখানা স’াপন করা যাবে না। নতুন এই আইনে স’াপনা নির্মাণে ক্ষেত্রে ভূমির উর্ধ্বমুখী ব্যবহারকে (ভার্টিক্যাল এক্মপানস) গুরুত্ব দেয়া হবে। এই আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ২ বছর কারদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন- আর্থিক দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে যাদের জমি স্বল্প (তিন থেকে ৫ শতক) তাদের ক্ষেত্রে বসত ভিটা নির্মাণে এ বিধান কিছুটা শিথিল করা হবে।