স্টাফ রিপোর্টার : দিনের শুরুতেই ‘সুখবর’ পান সফর আলী। একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের এই জেষ্ঠ ভিডিও এডিটরকে গত রোববার সকাল ১০টা ৯ মিনিটে গ্রামীণফোন নম্বর ০১৭০৮৩৩২৩৪৭ থেকে জানানো হয়, তিনি ১৫ হাজার ৫৭০ টাকার টকটাইম ও দুই থেকে ৫৬ লাখ টাকার মধ্যে কোনো পরিমাণ অর্থ পুরস্কার পাবেন। ফোন করা ব্যক্তিটি নিজেকে গ্রামীণফোন কর্মকর্তা নাহিদ বলে দাবি করেন।
সফর আলীর স্মার্টফোনে বিশেষ সফটওয়্যার চালু থাকায় কথোপকথন পুরোটাই রেকর্ড হয়। পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কথা হয়তো অনেক মোবাইল ব্যবহারকারীই শুনেছেন। কিছু চক্র সাধারণ মানুষকে পুরস্কার পাওয়ার প্রলোভন দেখায়, পরে ঐ পুরস্কার পেতে নির্দিষ্ট নম্বরে টাকা পাঠাতে বলে। সফর আলীও এমন এক ফাঁদে পড়তে যাচ্ছিলেন। সংবাদমাধ্যমকর্মী হওয়ায় সফর আলী এমন ‘ডিজিটাল ডাকাতের’ কথা শুনেছেন। গ্রামীণফোন কর্মকর্তা নাহিদ পরিচয় দেয়া ব্যক্তিকে ঐ কথা তিনি বলেন। সফর আলীকে গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ার নম্বরে ফোন করে নিশ্চিত হতে বলে ফোন কেটে দেন কথিত নাহিদ। গত রোববার সকালে ঘটনার পরপরই গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ার নম্বর ১২১-এ কল করেন সফর আলী। উল্লেখিত ঘটনা প্রতারণা বলে জানান কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিকে। তিনি এমন কল থেকে সাবধান থাকতে সফর আলীকে পরামর্শ দেন এবং অভিযোগ লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট মোবাইল নম্বরটি নেন। ঘটনার দিন দুপুরে সফর আলী প্রতারক চক্রের ব্যাপারে জানতে নিজেই ০১৭০৮৩৩২৩৪৭ নম্বরে কল করেন। প্রতারক আবার নিজেকে গ্রামীণফোন অফিসের কর্মী বলে পরিচয় দেন। বোনাস পেতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তি বিভিন্ন কথার মারপ্যাঁচে বলেন, আগামী পাঁচ বছর পাঁচ মাস সাতদিন কথা বলতে ১৫ হাজার ৫৭০ টাকা বোনাস ব্যবহার করা যাবে এবং এই সময়ে কোনো রিচার্জ করতে হবে না। আর পরে লটারির মাধ্যমে পাওয়া যাবে দুই থেকে ৫৬ লাখ টাকা। তবে বোনাস ও পুরস্কারের কথা গোপন রাখতে বলা হয়। বলা হয়, এ কথা জেনে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে। এরপর বলা হয়, বোনাস ১৫ হাজার ৫৭০ টাকার কয়েক বছর মেয়াদ পেতে ফোনে কথা বলা অবস্থায়ই ০১৭০৯৮৩১১৯৮ নম্বরে ১৫০ টাকা রিচার্জ করতে হবে সফর আলীকে। ১৫ মিনিট ১০ সেকেন্ডের মধ্যে কথা বলা অবস্থায়ই যদি রিচার্জ না করা হয়, তাহলে বোনাস ও পুরস্কার দুটোই বাতিল হয়ে যাবে। পরে আবার প্রতারক চক্রের মোবাইল থেকে কল করে ১৫ মিনিটের মধ্যে ১৫০ টাকা রিচার্জ পাঠাতে বলা হয়। ইয়েস অথবা নো বলে অফার বাতিলের কথা বলা হয় সফর আলীকে। সফর আলী ‘না’ বলে মোবাইল কেটে দেন। সফর আলীর মতোই ঘটনা ঘটেছে একই সংবাদমাধ্যমে কর্মরত নিউজরুম এডিটর সিরাজুম মুনিরার ক্ষেত্রে। গত শনিবার বিকেল ৪টা ৪৯ মিনিটে গ্রামীণফোন নম্বর ০১৭৩৫৫৫৫৫৩৪ থেকে তার নম্বরে কল আসে। বলা হয়, গ্রামীণফোনের বসুন্ধরা-বারিধারা অফিস থেকে ফোন করা হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়, সিমের মালিক কে এবং বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে কি না।
পরে গ্রামীণফোনের কর্মচারী দাবি করা ব্যক্তিটি বলেন, সিরাজুম মুনিরার নম্বরটি বেশ পুরোনো এবং গ্রামীণফোনের যে ৩০ হাজার সিমের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি এটি তারই একটি। এই ৩০ হাজারের মধ্যে লটারি করে ১০ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী নম্বরের মালিক ১৮ লাখ টাকা জিতেছেন বলে জানানো হয়। কথোপকথনের এই পর্যায়ে সিরাজুম মুনিরা বুঝতে পারেন এটি প্রতারণামূলক কল। বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে তিনি কল কেটে দেন। ইদানীং মোবাইল ফোনের কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে পুরস্কার পাওয়ার প্রলোভন দেখানো ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বন্ধুবান্ধব অথবা সহকর্মীদের মধ্যে অনেককেই পাওয়া যাবে যারা সমপ্রতি কোনো প্রতারণামূলক কল পেয়েছেন। এতে বোঝা যায় এর আশঙ্কাজনক রূপ। এসব কলের মূল ভাষা একই, বোনাস পাওয়া অথবা কোনো লটারিতে পুরস্কার জেতার খবর এবং ঐ পুরস্কার পেতে নির্দিষ্ট কোনো নম্বরে টাকা পাঠানো। প্রতারণামূলক কলের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ার থেকে জানানো হয়, কোনো নম্বর থেকে থেকে অভিযোগ পেলে তারা অভিযুক্ত নম্বরটি রাখেন। পরে ঐ নম্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখার পর এর যথাযথ পদক্ষেপ নিতে তা বিটিআরসির কাছে পাঠানো হয়। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটারনাল কমিউনিকেশনস সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, একদল অসাধু মানুষ এই ধরনের অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে আসছে এবং এই ধরনের প্রতারণা বন্ধে গ্রাহকদের সচেতনতা খুবই জরুরি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এর আগে বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য মাধ্যমে গ্রাহকদের জানিয়েছি যে, গ্রামীণফোন থেকে গ্রাহকদের শুধুমাত্র ১২১ নম্বর থেকে ফোন করা হয়। অন্য কোনো নম্বর থেকে ফোন করলে তা উপেক্ষা করার জন্য আমরা অনুরোধ করব। বোনাস আর পুরস্কারই নয়, বিকাশে টাকা পাঠানোকে কেন্দ্র করেও মোবাইল ফোনে প্রতারণা হচ্ছে। এমনই এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন একই সংবাদমাধ্যমের কর্মী কনটেন্ট এক্সিকিউটিভ সজীব খান। রোববার দুপুরে ০১৭২৭৩৯৫০৮২ নম্বর থেকে তাকে কল দিয়ে বলা হয়, এর আগের দিন বিকেলে তিনি (সজীব) বিকাশ করেছেন। আজ ভুল করে তার নম্বরে সাড়ে তিন হাজার টাকা গেছে। ০১৭৫৮৬১৩৩৮৭ নম্বরে টাকা ফেরত দেয়ার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তখনো সজীব খান কোনো বিকাশের কোনো বার্তা পাননি। পরে তার মোবাইলে একটি বার্তা আসে যেখানে বলা হয়, তার একাউন্টে তিন হাজার ৫০০ টাকা বিকাশ পাঠানো হয়েছে। তবে বার্তা প্রেরক নকধংয-এর স্থলে নকধপয। বানান ভুলের বিষয়টি দেখে সজীব খানের সন্দেহ হয়। তিনি নিজের বিকাশ একাউন্ট চেক করে দেখেন, কোনো টাকা যোগ হয়নি। অল্পের জন্য প্রতারণার হাত থেকে বেঁচে যান তিনি। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই এমন সৌভাগ্য হয় না।
এ প্রসঙ্গে বিকাশের কমার্শিয়াল বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহেদুল ইসলাম বলেন, মোবাইল ফোন প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপরাধীচক্র মাস্কিং কলের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট এবং গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছেন। মাস্কিং কল টেলিযোগাযোগ শিল্পের একটি পুরোনো সমস্যা। বিটিআরসি বিষয়টি অবগত আছে এবং সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। বিকাশ এমন প্রতারণা সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং নিয়মিত গ্রাহকদের সচেতন করছে। অপরাধ চক্রের হাত থেকে বাঁচতে করণীয় বিষয়ে মোহাম্মদ জাহেদুল ইসলাম বলেন, ফোনে কারো অনুরোধে বা নির্দেশে লেনদেন না করে আগে টেলিফোনকারীর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করুন। ফোন করে লটারি বা পুরস্কার জিতেছেন দাবি করলেই তা সত্য বলে ধরে নেবেন না। নিজের পিন নম্বর এবং একাউন্ট ব্যালান্স কারো সাথে শেয়ার করবেন না। মোট কথা, গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। মোবাইল ফোনে প্রতারণা এবং অপরাধমূলক কর্মকা- রুখতেই দেশে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে দেশে প্রায় নয় কোটি সিম নিবন্ধিত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হলে প্রত্যেক সিম ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে। তখন প্রতারণাকারীদের ধরা সহজ হবে। আর একই কারণে প্রতারণার হারও কমে যাবে।