অর্থনৈতিক রিপোর্টার
গত ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরির সাথে এখন পর্যন্ত ৩টি আন্তর্জাতিক হ্যাকার দলের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম বস্নুমবার্গ। সংবাদ মাধ্যমটির এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তকারীরা রিজার্ভ চুরির সাথে তিনটি হ্যাকার চক্রের সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। ৩টি দলের মধ্যে একটি পাকিস্তানের, অপরটি উত্তর কোরিয়ার। তৃতীয় দলটির পরিচয় সম্বন্ধে তদন্তকারীরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।
ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভের অর্থ চুরি যাওয়ার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর চুরির ঘটনা তদন্তের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ারআই নামের একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফায়ারআই-এর দুজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বস্নুমবার্গ জানিয়েছে, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার দুটি হ্যাকার গ্রুপ এই সাইবার চুরিতে জড়িত বলে ফরেনসিক পরীক্ষায় তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তৃতীয় হ্যাকার গ্রুপটির সদস্য কারা এবং তারা কোন দেশের নাগরিক সেটা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বস্নুমবার্গ বলছে, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া ছাড়াও আরেকটি অজানা পক্ষ এর সঙ্গে যুক্ত আছে। তবে সেই অজানা পক্ষের পরিচয় ও উৎস বের করা যায়নি। অজানা তৃতীয় পক্ষটি কোনো সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক কিংবা কোনো দেশের এজেন্ট কি না তা বোঝার জন্য যথেষ্ট তথ্য পায়নি ফায়ারআই। তবে ঐ পক্ষটিও প্রকৃত অপরাধী হতে পারে।
এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআই। সংবাদ মাধ্যম এএফপি’র বরাত দিয়ে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একথা জানানো হয়েছে।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ লোকজন জড়িত ছিল বলে সন্দেহ করছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। কম্পিউটার হ্যাকাররা এসময় প্রায় ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ফাঁকফোকর নতুন করে উন্মোচিত হয়েছে। এফবিআই’র গুপ্তচরেরা যেসব প্রমাণ পেয়েছেন তাতে নিউইয়র্কেও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐ অর্থ চুরিতে অন্তত একজন ব্যাংককর্মীর জড়িত থাকার বিষয়ে ইঙ্গিত মিলেছে। আরও কয়েকজন বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার ব্যবস্থায় ঢুকতে হ্যাকারদের সহযোগিতা করে থাকতে পারেন বলেও সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণে ইঙ্গিত রয়েছে। তদন্তকারীরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কম্পিউটারে ঢুকে হ্যাকাররা গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা করেছিল। তারা আন্তঃব্যাংক তহবিল স্থানান্তরের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা পাঠায়। সে অনুযায়ী অর্থের একটি চালান ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের কাছে চলে যায়।
উল্লেখ্য, গত ৫ ফেব্রুয়ারি সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে সংরক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার সরানোর চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে ৪টি মেসেজের মাধ্যমে ফিলিপাইনের রিজল ব্যাংকে সরিয়ে নেয়া হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। আরেকটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার একটি এনজিওর (শালিকা ফাউন্ডেশন) নামে ২ কোটি ডলার সরিয়ে নেয়া হলেও ‘ফাউন্ডেশন’র স্থলে ‘ফান্ডেশন’ বানান ভুলজনিত সন্দেহের কারণে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। ইতিহাসের অন্যতম বড় এই সাইবার জালিয়াতির ঘটনা জানাজানির পর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে দুজন ডেপুটি গভর্নরকেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় সরকার। ঐ দিনই এই ডলার চুরি যাওয়ার বিষয়টি তদন্তের জন্য সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্র্তী প্রতিবেদন এবং ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে সময় বেঁধে দেয়া হয়। ড. ফরাসউদ্দিন এরইমধ্যে অন্তর্বর্র্তী প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দিয়েছেন।