KBDNEWS: বিমানবন্দরে নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়ার পর এবার বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কার্গো পরিবহণে যুক্তরাজ্য অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। এতে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে দেশের তৈরি পোশাক, সবজিসহ রফতানিমুখী বেশকিছু পণ্য। বিশেষ করে ইউরোপে সবজি রফতানিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র ও দক্ষ জনবল না থাকার অভিযোগ তুলে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গত মঙ্গলবার রাতে তাদের ওয়েবসাইটে এ নোটিশ জারি করা হয়। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যের সরাসরি ফ্লাইটের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে।
এছাড়াও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তার বিষয়ে আরো যত্নবান হবে।
এদিকে কার্গো পরিবহণে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও ঢাকা-লন্ডন সরাসরি যাত্রী পরিবহণে সন্তোষ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য।
অন্যদিকে বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় গত তিন মাসেও অস্ট্রেলিয়া তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। গত ডিসেম্বর থেকে দেশটি বিমানে কার্গো নিচ্ছে না। এতে প্রতিদিন গড়ে অর্ধশত কোটি টাকার ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় যুক্তরাজ্যে কার্গো পরিবহণ বন্ধ হওয়ায় মাসে ২ হাজার কোটি টাকা হাতছাড়া হওয়ার আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনের দাবি, এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচলে অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও জনবলের অভাবের পেছনে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করেছে যুক্তরাজ্য। সামপ্রতিক বিমান দুর্ঘটনার জেরে লন্ডন, বাংলাদেশে কার্গো ফ্লাইটের চলাচল বন্ধ করায় বিমানকে বড় ধরনের মাশুল গুণতে হচ্ছে।
পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে পণ্য নেয়ার হার কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
ব্রিটিশ বাংলাদেশ ইম্পোটার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রফিক হায়দার বলেন, ৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলার সমমূল্যের পণ্য আমরা বাংলাদেশ থেকে আমদানি করি। এতে করে কৃষকরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই সাথে যারা বাংলাদেশ থেকে আমাদের মাল সরবরাহ করে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এখানে আমাদের বাজারটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারের উদাসীনতাসহ কতিপয় কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলা এই নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে যতো দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ সরকারকে ব্রিটিশ সরকারের সাথে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের মেম্বারশিপ পরিচারক মো. মনির আহমেদ। এ ব্যাপারে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার নাদিম কাদির জানান, এই নিষেধাজ্ঞা সাময়িক সময়ের জন্য এবং এ বিষয়ে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সাথে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছে।
জানা গেছে, যুক্তরাজ্য এভিয়েশন গোয়েন্দা দল তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে বিমানে ঢাকা-লন্ডন সরাসরি যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও কার্গো পণ্য পরিবহণে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছিল, বিমানের কার্গো রফতানি টার্মিনালটি বহিরাগত জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ ধরনের জনবল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। রফতানি টার্মিনালে কর্মরত ৩০০ জনবলের মধ্যে মাত্র ৬০ জন বিমানের নিজস্ব। বাকিরা বিভিন্ন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও বহিরাগত। এদের মধ্যে চোরাচালানসহ বিভিন্ন মামলার আসামিও আছে। নামমাত্র স্ক্যানের পর এরা টার্মিনালে প্রবেশ করছে। একইভাবে স্ক্যান ছাড়াই অবাধে পণ্যসামগ্রীও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে উঠানো হচ্ছে। এ অবস্থায় কার্গো পণ্যের সাথে বোমা বা অন্য কোনো এক্সপ্লোসিভ বিমানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার মতো আশংকার কথাও বলা হয়েছে যুক্তরাজ্যের রিপোর্টে। নিরাপত্তা শিথিলতায় কার্গো ফ্রেটগুলো যেসব দেশের বিমানবন্দরে যাচ্ছে সেখানে বড় ধরনের নাশকতার আশংকাও আছে। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অবিলম্বে এ অবস্থার উন্নতি না হলে তারা ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যে কার্গো পরিবহণ বন্ধ করে দেবে।
কার্গো শাখা সূত্রে জানা গেছে, শর্তসাপেক্ষে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে সরাসরি কার্গো রফতানি করতে প্রয়োজনীয় সনদ ‘এয়ার কার্গো সিকিউরিটি-৩ (এসিসি)’ ও ‘রেগুলেশন এজেন্ট-৩ (আরএ)’ সনদ নবায়ন করেছে। গত জানুয়ারিতে তিন মাসের জন্য বিমানকে এই সনদ দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কার্গো কমপ্লেক্সের জনবল কাঠামো ঠিক না হলে মার্চের পর তারা আর এই সনদ নবায়ন করবে না। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে সব ধরনের রফতানি কার্যক্রম। বিমানের একটি সূত্র জানায়, নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন করতে শাহজালাল বিমানবন্দরের জন্য ২৫০ সদস্যের জনবল নিয়োগ দিলেও সরকার কার্গো (রফতানি) শাখায় নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেয়নি। খোদ বিমান বোর্ড জনবল নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে যুক্তরাজ্যের সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও বিমান কর্তৃপক্ষ কার্গো রফতানি শাখায় জনবল নিয়োগ দিতে পারছে না। যার ফলেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাজ্য।
জানা গেছে, গত ১৯ ডিসেম্বরের পর বিমানের কার্গো ভিলেজ থেকে শুধু মরদেহ ও ২ গ্রাম ওজনের কূটনৈতিক ডকুমেন্ট ছাড়া অন্য কোনো পণ্য অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কার্গো রফতানি টার্মিনালে অস্ট্রেলিয়াগামী রফতানিযোগ্য পণ্যের স্তূপ জমে গেছে। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা অন্য পথে তাদের পণ্য পাঠানোর চেষ্টা করছেন। এতে অধিকাংশ ব্যবসায়ীকেই লোকসান গুণতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল এলাইট প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহম্মেদ জানান, বর্তমানে বছরে ১ হাজার থেকে ১৫শ কোটি টাকার বেশি সবজি রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। এর অধিকাংশই যাচ্ছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এ মুহূর্তে যদি যুক্তরাজ্য সবজি নেয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে ২ শতাধিক ব্যবসায়ীকে পথে বসতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ঢাকা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য যুক্তরাজ্যকে দায়িত্ব দেয়। তাই অস্ট্রেলিয়ার পর যুক্তরাজ্যের এই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকেও আরো প্রভাবিত করতে পারে।