রাজশাহী প্রতিনিধি: আজ শুক্রবার দুপুরে রাজশাহীর কাটাখালী থানার সামনে রাজশাহী-নাটোর সড়কে বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাসে আগুন ধরে যায়। আগুনে পুড়ে মারা যান মাইক্রোবাসের ১৭ যাত্রী। স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে তাঁরা সবাই রংপুর থেকে রাজশাহীতে বেড়াতে আসছিলেন। পুড়ে চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিহত যাত্রীদের সবার লাশ শনাক্ত করা যায়নি। চিকিৎসকেরা বলছেন, ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া এঁদের চিহ্নিত করা কঠিন হবে।স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত ১৭ জনের বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে। এর মধ্যে চৈত্রকোল ইউনিয়নের বড়রাজাপুর গ্রামের একই পরিবারের পাঁচজন, রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় মহাজিদপুর গ্রামের একই পরিবারের পাঁচজন, রায়পুর ইউনিয়নের দাড়িকাপাড়া গ্রামের একই পরিবারের তিনজন, পৌর এলাকার প্রজাপাড়ার একই পরিবারের তিনজন এবং দুরামিঠিপুর গ্রামের একজন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন বড় রাজারামপুর গ্রামের সালাহউদ্দিন (৪৪), তাঁর স্ত্রী সামসুন্নাহার (৩২), শ্যালিকা কামরুন্নাহার (২৫), ছেলে সাজিদ (৯) ও মেয়ে সাবাহ খাতুন (৩), রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় মহাজিদপুর গ্রামের ফুল মিয়া (৪০), তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম (৩২), ছেলে ফয়সাল (১৩), মেয়ে সুমাইয়া (৭) ও মেয়ে সাবিহা (৩), পৌরসভার প্রজাপাড়ার তাজুল ইসলাম (৪০), স্ত্রী মুক্তা বেগম (৩৫), ছেলে ইয়ামিন (১৪), রামনাথপুর ইউনিয়নের দাড়িকাপাড়া গ্রামের মোখলেছার রহমান (৪০), স্ত্রী পারভিন বেগম (৩৫), ছেলে পাভেল মিয়া (১৮) এবং দূরামিঠিপুর গ্রামের সাইদুর রহমান (৪৫)।
বড় রাজারামপুর গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, সালাউদ্দিন বিয়ে করে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে থাকতেন। স্ত্রী, শ্যালিকা ও দুই সন্তানকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে রাজশাহীতে ঘুরতে যান। এ সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তাঁরা মারা যান।
বোন নাজমা খাতুন (২৮) রাজশাহীতে ভাইয়ের বাসায় আসছিলেন। ভাই রাজশাহী সেনানিবাসের সার্জেন্ট নূর মোহাম্মদ। নগরের তেরখাদিয়া এলাকায় বাসা নিয়ে থাকেন। পথে আসতে আসতে ভাই বারবার বোনকে ফোন করে জেনে নিচ্ছিলেন কত দূর তাঁরা। বোন বলছিলেন, ‘আমরা নাটোরে, আর এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে। তোমার বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুরতে বের হব।’
আজ শুক্রবার দুপুরে রংপুর থেকে মাইক্রোবাসে স্বামী–সন্তান নিয়ে রাজশাহীতে আসছিলেন নাজমা। সঙ্গে ছিলেন স্বামী ফুল মিঞা (৩৫), ছেলে ফয়সাল আহাম্মদ (১১), মেয়ে সাদিয়া (৭) ও সুমাইয়া (৪)। তাঁদের বাড়ি রংপুরে পীরগঞ্জ এলাকার বড়মহজিদপুর গ্রামে। রাজশাহীর কাটাখালীতে যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে নিহত ১৭ জনের সঙ্গে এই পরিবারের সবাই মারা গেছেন। আজ বেলা পৌনে দুইটার দিকে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের কাপাশিয়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বোনের সঙ্গে শেষ কথা হওয়ার এক ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পর সার্জেন্ট নূর মোহাম্মদ ফোন দেন। তখন বেলা দুইটা বাজে। বোন নাজমা আর ফোন ধরছেন না। তখন ভগ্নিপতি ফুল মিঞাকে ফোন দেন। তিনিও ফোন ধরছেন না। তখন তিনি মনে করেছেন, নেটওয়ার্কের সমস্যা। একটু পরে আবার চেষ্টা করতে থাকেন। ফোন বাজে, কিন্তু বোন-ভগ্নিপতি কেউ ফোন ধরেননি। এরপর আবার ফোন দেন, তখন ফোন বন্ধ পান। এরপর থেকে তিনি অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। এরই মধ্যে মাইক্রোবাসের চালকের এক বন্ধু কীভাবে যেন খবর পেয়ে তাঁর চাচাতো ভাইকে দুর্ঘটনার কথা বলেছেন। তাঁর চাচাতো ভাই তাঁকে ফোন করে বলেছেন, যে মাইক্রোবাসে তাঁর বোনেরা রাজশাহীতে যাচ্ছিলেন, সেই মাইক্রোবাসটি দুর্ঘটনায় পড়েছে। গাড়ির সবাই মারা গেছেন।এরপর তিনি বাসা থেকে বের হয়ে নগরের বর্ণালীর মোড়ে আসেন। সেখানে একজন অটোরিকশাচালককে জিজ্ঞেস করেন। অটোচালক বলেন, কাটাখালীতে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেক মানুষ মারা গেছেন। এরপর তিনি কাটাখালীতে এসে দেখেন কেউ নেই। সব লাশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে বোনের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে। তখন বলেছিল, তারা নাটোরে আছে। আর এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে তারা রাজশাহীতে পৌঁছে যাবে। বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে ঘুরতে বের হবে।’ নূর মোহাম্মদ বলেন, তাঁরা পাঁচ ভাইবোন। ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর আগে বড় দুই বোন রয়েছে। তাঁর বোনদের মধ্যে নাজমা ছোট। তিনি বলেন, ওরা দুপুরে বাসায় খাবে, এ জন্য তিনি বাসায় সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এখন কীভাবে সব শেষ হয়ে গেল! নূর মোহাম্মদের গলা বুজে আসে।