স্টাফ রিপোর্টার : জোড়া মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করা দুই বোন রাবেয়া-রোকেয়ার সফল অস্ত্রপচার শেষে নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুজিব শতবর্ষে রাবেয়া-রোকেয়া ঘরে ফিরেছে এটাই আমাদের সবার জন্য আনন্দের এবং গর্বের। গতকাল রোববার দুপুরে জোড়া মাথা নিয়ে জন্ম নেয়া যমজ শিশু রাবেয়া ও রোকেয়ার সফল চিকিৎসা শেষে মুজিব শতবর্ষে গৃহ প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) প্রান্তে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন। সিএমএইচ প্রান্তে রাবেয়া-রোকেয়ার মা-বাবা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও তাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত দেশি-বিদেশি চিকিৎসক ও সম্মিলিত হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে সত্যি একটা আনন্দের দিন। আমার মনে আছে রাবেয়া-রোকেয়ার কথা। আমাকে জানিয়েছিল আমার ছোট বোন শেখ রেহানা। সে পত্রিকায় প্রথম দেখে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটা মেসেজ দিল যে, তুমি দেখো এরকম দুটো বাচ্চার জন্য কী করা যায়। এর চিকিৎসার জন্য কিছু করা যায় কিনা। তিনি বলেন, রেহানা বলার পর আমি সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিলাম এবং ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কারণ সামন্ত লাল সেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। কামালের সাথেই সে ছিল। তাকে আমি খুব ভালভাবে চিনি এবং তার ভিতরে যে মানবিক গুণ আছে সেটা আমি জানি। তাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে যোগাযোগ করে রাবেয়া-রোকেয়াকে ঢাকায় আনা এবং ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
তিনি বলেন, আজকে আমি সত্যি খুব আনন্দিত যে এত দীর্ঘ চিকিৎসার পর রাবেয়া-রোকেয়ার সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। মার্চ মাস আমাদের বাঙালির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসেই আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছেন। এ মাসেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আবার এই মাস থেকেই কিন্তু আমাদের ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। সেই মার্চ মাসেই আমাদের প্রিয় রাবেয়া-রোকেয়া নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছে এটা সত্যি খুব আনন্দের। তিনি আরো বলেন, এই চিকিৎসাটা যখন শুরু হল, আমরা দেখেছি যে প্রত্যেকের ভেতরে সুস্থ করে তোলার একটা আগ্রহ ছিল এবং সবচেয়ে ভালো লাগলো যে ডাক্তার-নার্স থেকে শুরু করে টেকনেশিয়ান প্রত্যেকের একটা আলাদা সহানুভূতি ছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অ্যাকশন ফর ডিফেন্স পিপল ফাউন্ডেশন (এডিপিএফ) নামে হাঙ্গেরিয়ান একটা ফাউন্ডেশন আছে ।
এই ফাউন্ডেশনের খবরটা দিয়েছিল জার্মানিতে আওয়ামী লীগ করে আমাদের হাসনাত মিয়া। সে ওই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখানে কিছু জার্মানির ডাক্তার, হাঙ্গেরিয়ান ডাক্তার এবং বিভিন্ন সোশ্যাল ওয়ার্ক করে এমন লোকজন আছেন। তাদের নিয়ে আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নামে যে হাসপাতালটা করেছি, সেই বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে তারা ভিজিট করতে এসেছিল, দেখতে এসেছিল, আমাদের এখানে কিছুদিন ট্রেনিং দিতে এসেছিল। তারা যখন এ ধরনের একটা ঘটনা শুনল তারাও আগ্রহ প্রকাশ করল, তখনই রাবেয়া রোকেয়াকে আনা হলো। তিনি বলেন, রাবেয়া-রোকেয়াকে হাঙ্গেরি পাঠালাম, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীকে আমি মেসেজ দিয়েছিলাম এবং আমি নিজেও যখন হাঙ্গেরি যাই তখন এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। আমি হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীকেও ধন্যবাদ জানাই। কারণ তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন এবং এই প্রতিষ্ঠানটিকে তারা সরকারিভাবে সবরকম সহযোগিতা করেন এবং দীর্ঘদিন রাবেয়া-রোকেয়ার চিকিৎসা ওখানে হয়। ইতোমধ্যে প্রায় ৪৮টা অপারেশন হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা চিন্তাও করা যায় না। বোধহয় মেডিকেল সাইন্সে এ ধরনের ঘটনা খুব কম দেখা যায়। তিনি বলেন, ঠিক যখন সেপারেশনটা হবে, তখন কোথায় হবে সেটা নিয়ে একটু কথা হচ্ছিল। বার্ন ইনস্টিটিউটে আমাদের সুন্দর প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমি আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা সিএমএইচে করব। কারণ বাংলাদেশে করার উদ্দেশ্যটা হল, এখানে আমাদের যারা ডাক্তার বা যারা এখানে কাজ করে, তাদের একটা অভিজ্ঞতা হবে। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা ৩৩ ঘণ্টা একটানা অপারেশন করেছেন, এটা বিরাট ব্যাপার। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি, সবচেয়ে ভালো লেগেছে যের সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। এত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন, সেটা আমি ভাষায় বলতে পারব না। তিনি বলেন, এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা পারদর্শী তাদের সবাইকে একত্র করা হয়েছে। যেন কোনোরকম ফাঁক না থাকে, সব যেন ঠিকমতো করা হয়। কারণ এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার যে রাবেয়া-রোকেয়া জোড়া মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় যেটাকে বলে ক্রেনিয় গেগাস। এ ধরনের ঘটনা মাঝে মাঝে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের অপারেশন সম্পূর্ণ নতুন একটা কাজ।
ধন্যবাদ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন রাবেয়া-রোকেয়াকে রাখা, তার বাবা-মাকে রাখা এবং তাদের পরিচর্যা করা, তাদের সবরকম সুযোগ সুবিধা দেয়া, সব মিলিয়ে অত্যন্ত মানবিক একটা কাজ আপনারা করেছেন। আজকে রাবেয়া-রোকেয়া বাড়ি ফিরে যাবে, তার বাবা-মার কোলে আজকে হেসেখেলে বেড়াবে, এটা সত্যি খুব বড় পাওয়া। রাবেয়া-রোকেয়ার জন্য দোয়া চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই দোয়া করবেন, আমি দেশবাসীরও দোয়া চাই। তারা যেন সুস্থ থাকে ভালো থাকে এবং বাবা-মার বুকে আনন্দ নিয়ে আসতে পারে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট ৩৩ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর মাথা জোড়া লাগানো যমজ শিশু রাবেয়া-রোকেয়াকে সফলভাবে আলাদা করা হয়। রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই অস্ত্রোপচার হয়। এতদিন সেখানেই চিকিৎসাধিন ছিল শিশু দুটি। এর আগে পাবনার চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের এই কন্যাশিশুদের ২০১৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এখানে দুই স্তরে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত জানুয়ারিতে শিশু দুটিকে হাঙ্গেরি পাঠানো হয়। সেখানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৮টি অস্ত্রোপচার করা হয়।